বাঙ্গালী
Friday 26th of April 2024
0
نفر 0

কেন শিয়াদের মাজহাব সুন্নিদের চেয়ে ভিন্ন? এটা কী ঐক্যের অন্তরায়?

প্রশ্ন: কেন শিয়া মুসলমানরা অধিকাংশ মুসলমানের মতাদর্শের অনুসরণ করেন না? অথচ মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি (যা বর্তমান যুগেও) সবচেয়ে বেশি জরুরি এবং মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা দূর করার একমাত্র পথ হল অধিকাংশের মতাদর্শকে গ্রহণ। অধিকাংশ মুসলমানের মতাদর্শ বলতে আকীদার ক্ষেত্রে আশা’আরী মতবাদ(*১) ও ফিকাহর ক্ষেত্রে আহলে সুন্নাত আল জামাআত তথা সুন্নি মুসলমানদের মাজহাবকেই(*২) বোঝানো হয় সাধারণত।
কেন শিয়াদের মাজহাব সুন্নিদের চেয়ে ভিন্ন? এটা কী ঐক্যের অন্তরায়?

প্রশ্ন: কেন শিয়া মুসলমানরা অধিকাংশ মুসলমানের মতাদর্শের অনুসরণ করেন না? অথচ মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি (যা বর্তমান যুগেও) সবচেয়ে বেশি জরুরি এবং মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা দূর করার একমাত্র পথ হল অধিকাংশের মতাদর্শকে গ্রহণ। অধিকাংশ মুসলমানের মতাদর্শ বলতে আকীদার ক্ষেত্রে আশা’আরী মতবাদ(*১) ও ফিকাহর ক্ষেত্রে আহলে সুন্নাত আল জামাআত তথা সুন্নি মুসলমানদের মাজহাবকেই(*২) বোঝানো হয় সাধারণত।
 
 
 
উত্তর: প্রথমত: শিয়া মুসলমানরা মনে করেন শরীয়ত-সম্মত দলিল-প্রমাণই নবী (সাঃ)-এর আহলে বাইতের অনুসরণকে অপরিহার্যতা দান করেছে। যেহেতু তাঁরা নবুওয়াতের ছায়ায় প্রশিক্ষিত হয়েছেন, তাঁদের ঘরে ফেরেশতাদের আসা-যাওয়া ছিল, সেখানে আল্লাহ্ ওহী ও কোরআন অবতীর্ণ করেছেন তাই শিয়ারা আকীদা-বিশ্বাস, ফিকাহ্ ও শরীয়তের আহ্কাম কোরআন ও সুন্নাহর জ্ঞান, চারিত্রিক গুণ ও বৈশিষ্ট্য এবং সামাজিক আচরণের ক্ষেত্রে তাঁদের অনুসারী হয়েছেন। শিয়ারা এটি করেন কেবল যুক্তি-প্রমাণের প্রতি আত্মসমর্পণের কারণে। আল্লাহর রাসূলের সুন্নাহর প্রতি বিশ্বাসের কারণেই শিয়া মুসলমানরা এ পথকে বেছে নিয়েছেন।
 
 
 
দ্বিতীয়ত: শিয়া মাজহাবের দৃষ্টিতে সুন্নি মাজহাব অন্য মাজহাবের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য কোন যুক্তি উপস্থাপনে সক্ষম নয় বলে কিরূপে এর অনুসরণ অপরিহার্য  বা ফরজ হতে পারে? শিয়া মুসলমানরা মুসলমানদের প্রদর্শিত যুক্তিগুলোর ওপর পরিপূর্ণ ও যথার্থ দৃষ্টি দিয়ে পর্যালোচনা ও গবেষণা চালিয়েছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা আহলে সুন্নাহর অনুসরণের পক্ষে উপযুক্ত কোন দলিল পাননি। আহলে সুন্নাতের অনুসরণের সপক্ষে যুক্তি হিসেবে অনেকেই তাদের ইমামদের নানা গুণ আর যোগ্যতা যেমন- আমানতদারী, ন্যায়পরায়ণতা, ইজতিহাদের ক্ষমতা, মর্যাদা প্রভৃতির কথা বলেন। কিন্তু এসব বিষয় শুধু তাঁদের মধ্যেই ছিল না, অন্যরাও এর অধিকারী ছিলেন। তাই শুধু তাঁদের মাজহাবের অনুসরণ কিভাবে ওয়াজিব বলে গণ্য হবে?
 
 
 
শিয়া মুসলমানরা এটাও মনে করেন না যে জ্ঞান ও কাজের দিক থেকে সুন্নি মাজহাবের শ্রদ্ধেয় ইমামগণ শিয়া মাজহাবের ইমামদের চেয়েও উত্তম। বরং নবী (সাঃ)-এর পবিত্র বংশধর যাঁরা হলেন উম্মতের মুক্তির তরণী, ক্ষমার দ্বার(*৩), ধর্মীয় বিভক্তির ফেতনা হতে রক্ষার কেন্দ্র, হেদায়েতের পতাকাবাহী, রাসূলের রেখে যাওয়া সম্পদ এবং ইসলামী উম্মতের মাঝে রাসূলের স্মৃতিচিহ্ন- তাঁরা অবশ্যই সর্বোত্তম। কারণ তাঁদের সম্পর্কে রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “তাদের থেকে তোমরা অগ্রগামী হয়ো না তাহলে তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে, তাঁদের সঙ্গে সংযুক্ত হবার ক্ষেত্রে অবজ্ঞার পথ বেছে নিও না তাহলেও তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে, তাঁদেরকে কোন কিছু শিক্ষা দিতে যেও না কারণ তাঁরা তোমাদের  চেয়ে বেশি জ্ঞানী।”
 
 
 
কিন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের কারণে অন্যরা তাঁদের অগ্রগামী হয়েছেন। সুন্নি ভাইদের অনেকেই এ বিষয়ে অবহিত নন যে, পূর্ববর্তী সৎ কর্মশীলগণ ও পরবর্তীতে যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে রাসূলের বংশধরদের অনুসারীগণ তথা শিয়া মুসলমানরা প্রকৃতপক্ষে মুসলিম উম্মাহর অর্ধেক ছিলেন এবং তারা আহলে বাইতের ইমামগণ ও রাসূলুল্লাহর রেখে যাওয়া দ্বিতীয় ثقل বা ভারী বস্তুর প্রতি ঈমান রাখতেন (প্রথমটি কুরআন ও দ্বিতীয়টি মহানবী-সা.’র পবিত্র বংশধর বা আহলে বাইত)। এ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি দেখা যায় নি এবং তাঁরা হযরত আলী (আঃ) ও ফাতিমা (আঃ)-এর সময়কাল হতে এখন পর্যন্ত এ প্রথানুযায়ী আমল করেছেন। সে সময়ে আশা’আরী, চার মাজহাবের ইমামগণ বা তাঁদের পিতৃকুলেরও কেউই ছিলেন না।
 
 
 
তৃতীয়ত:  হিজরি প্রথম তিন শতাব্দীতে মুসলমানরা সুন্নি মাজহাবগুলোর কোনটিরই অনুসারী ছিলেন না। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতাব্দীর মুসলমানদের অবস্থান কোথায় আর এ মাজহাবগুলোরই বা অবস্থান কোথায়? অথচ সে সময়কাল ইসলামের জন্য শ্রেষ্ঠ সময় ছিল বলে সুন্নি আলেমগণই স্বীকার করে থাকেন। আশা’আরী ২৭০ হিজরিতে জন্মগ্রহণ করেন ও ৩৩৫ হিজরিতে মৃত্যুবরণ করেন। আহমদ ইবনে হাম্বল ১৩৪ হিজরিতে জন্ম ও ২৪১ হিজরিতে মৃত্যুবরণ করেন। শাফেয়ী ১৫০ হিজরিতে জন্মগ্রহণ ও ২০৪ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন। মালিক ৯৫ হিজরিতে জন্ম ও ১৭৯ হিজরিতে ওফাত প্রাপ্ত হন। আবু হানীফা ৮০ হিজরিতে জন্ম ও ১৫০ হিজরিতে মৃত্যুবরণ করেন।
 
 
 
কিন্তু শিয়ারা ইসলামের প্রাথমিক যুগ হতে নবী (সাঃ)-এর আহলে বাইতের প্রতি অনুগত ছিলেন কারণ আহলে বাইত নবুওয়াতের ঘরের বিষয়ে বেশি জানতেন অথচ অন্যরা তখন সাহাবী ও তাবেয়ীদের অনুসরণ করতেন।(*৪)
 
 
 
তাই কোন্ যুক্তিতে সব মুসলমানকে তিন শতাব্দী পর(*৫) যেসব মাজহাবের উৎপত্তি হয়েছে সেগুলোর প্রতি আনুগত্যের শপথ দেয়া হয় অথচ প্রথম তিন শতাব্দীর অনুসৃত পথের কথা বলা হয় না? কি কারণে তাঁরা মহান আল্লাহর গ্রন্থ কোরআনের সমকক্ষ অপর ’ভারী বস্তু’ তথা মহানবীর (সা) রক্তজ বংশধর, তাঁর জ্ঞানের দ্বার, মুক্তি-তরণী, পথ-প্রদর্শক, উম্মতের রক্ষা পাবার পথ হতে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছেন?
 
 
 
চতুর্থত: কেন ইজতিহাদের যে পথটি তিন শতাব্দী ধরে মুসলমানদের জন্য উন্মুক্ত ছিল হঠাৎ করে তা চিরতরে বন্ধ করে দেয়া হল? এটি অক্ষমতার আশ্রয় গ্রহণ, আস্থা হতে অনাস্থা ও অলসতার দিকে প্রত্যাবর্তন বৈ কিছু নয়। এটি কি অজ্ঞতায় সন্তুষ্টি ও বঞ্চনায় তুষ্টতার নামান্তর নয়?
 
 
 
কোন্ ব্যক্তি জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে নিজেকে এ বাস্তবতার প্রতি সন্তুষ্ট মনে করতে পারে এবং বলতে পারে?
 
 
 
মহান আল্লাহ্ তাঁর প্রেরিত নবী ও রাসূলদের সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকে সর্বোত্তম গ্রন্থ যা চূড়ান্ত জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও আইনের সমষ্টি তা দিয়ে প্রেরণ করেছেন যাতে করে তাঁর দীন পূর্ণাঙ্গ ও নিয়ামত সম্পূর্ণ হয় এবং কিয়ামত পর্যন্ত সব কিছুর সমাধান তা থেকে পাওয়া যায়। অথচ তা চার মাজহাবের ইমামের মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটবে এবং তাঁরা সকল জ্ঞানকে সমবেত করবেন এমনরূপে যে অন্যদের অর্জন করার মত কিছু অবশিষ্ট থাকবে না যেন কোরআন, সুন্নাহ্ ও ইসলামের বিধি-বিধান এবং অন্যান্য দলিল-প্রমাণ কেবল তাঁদেরই মালিকানা ও সত্তায় দেয়া হয়েছে অন্যরা এ সকল বিষয়ে মত প্রকাশের কোন অধিকার রাখেন না। তবে কি তাঁরাই নবীগণের উত্তরাধিকারী ছিলেন? কিংবা এমন যে মহান আল্লাহ্ তাঁর নেতৃত্ব ও প্রতিনিধিত্বের সিলসিলা তাঁদের মাধ্যমে সমাপ্ত করেছেন, এমন কি অতীত ও ভবিষ্যতের জ্ঞানও তাঁদের দেয়া হয়েছে এবং তাঁদের এমন কিছু দেয়া হয়েছে যা বিশ্বজগতের কাউকে দেয়া হয় নি? না, কখনোই নয়, বরং তাঁরাও অন্য জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গের মত ইসলামের খেদমতকারী ও ইসলামের প্রতি আহ্বানকারী ছিলেন এবং দীনের আহ্বানকারীগণ জ্ঞান ভাণ্ডারের দ্বারকে কখনো বন্ধ করেন না, তার পথকেও কখনো রুদ্ধ করেন না। তাঁদেরকে কখনো এজন্য সৃষ্টি করা হয় নি যে, বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তিকে অবরুদ্ধ করবেন বা মানব জাতির চক্ষুকে বেঁধে রাখবেন। তাঁরা মানুষের হৃদয়কে তালাবদ্ধ, কানকে বধীর, চোখকে পর্দাবৃত ও মুখকে তালাবদ্ধ করতে আসেন নি। তাঁরা হাত, পা বা গর্দানেও কখনো শেকল পরাতে চান না। মিথ্যাবাদী ছাড়া কেউই তাঁদের প্রতি এরূপ অপবাদ আরোপ করতে পারে না। তাঁদের নিজেদের কথাই এর সর্বোত্তম প্রমাণ।(*৬)
 
 
 
পঞ্চমত: মুসলমানদের মুক্তি ও ঐক্যের প্রসঙ্গে শিয়া আলেমগণ মনে করেন মুসলমানদের ঐক্যের বিষয়টি সুন্নি হয়ে যাওয়া বা সুন্নি সম্প্রদায়ের শিয়া হবার ওপর নির্ভরশীল নয়, এজন্যই শিয়াদের ওপরও এমন কোনো দায়িত্ব বর্তায় না যে, নিজের মাজহাব থেকে সরে আসবে। যেহেতু এটি যুক্তিহীন তেমনি বাস্তবে এটি সম্ভবও নয় যা পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে মোটামুটি বোঝা যায়।
 
 
 
তাই মুসলমানদের ঐক্য যেখানে সম্ভব তা হল সুন্নি ভাইয়েরা আহলে বাইতের পথকে একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন মাজহাব বলে স্বীকৃতি দান করুন এবং মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত মাজহাবগুলো একে অপরকে যে দৃষ্টিতে দেখে তদ্রুপ আহলে বাইতের অনুসারী মাজহাবকেও তথা শিয়াদেরকেও দেখুন। যে কোন মুসলমানই যেরূপ স্বাধীনভাবে হানাফি, শাফেয়ী, মালিকী ও হাম্বলী মাজহাবের অনুসরণ করতে পারেন সেরূপ যেন আহলে বাইতের মতানুসারেও আমল করতে পারেন।
 
 
 
এ পদ্ধতিতে মুসলমানদের বিচ্ছিন্নতা ও বিভেদ একাত্মতায় পরিণত হবে এবং এ ঐক্য সুশৃঙ্খল ও সংহতও হবে। (উল্লেখ্য, মিশরের প্রখ্যাত সুন্নি আলেম আলআজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান মরহুম শেইখ মাহমুদ শালতুত এক ঐতিহাসিক ফতোয়ায় শিয়া মাজহাবকে মুসলমানদের পঞ্চম মাজহাব বলে স্বীকৃতি দিয়ে আধুনিক যুগেও ইসলামী-ঐক্যের দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯৫৯ সালের সেই ঐতিহাসিক ফতোয়ার পরও মিশরের আলআজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত সুন্নি আলেমদের অনেকেই এই একই মত প্রকাশ করে আসছেন। এখানে শেইখ শালতুতের সেই ঐতিহাসিক ফতোয়ার ছবি দেয়া হল।)


source : irib
0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

মহানবী (স.) হতে বর্ণিত ৪০টি হাদীস (২)
যদি কেউ দাড়ি না রাখে তাহলে সে কি ...
পবিত্র ঈদে গাদীর
দাওয়াতে দ্বীনের গুরুত্ব ও ...
কারবালা ও ইমাম হোসাইন (আ.)- ১ম পর্ব
ইমাম মাহদী (আ.) এর আবির্ভাবের ৬ মাস ...
হাসনাইন (ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন) ...
মসনবীর গল্প
অর্থসহ মাহে রমজানের ৩০ রোজার দোয়া
ইমাম হাসান আসকারী (আ.) এর জন্ম ...

 
user comment