বাঙ্গালী
Saturday 20th of April 2024
0
نفر 0

সূরা তওবার ৪৩ নং আয়াত ও মহানবী (সা.)-এর নিস্পাপত্ব প্রসঙ্গ

সূরা তওবার ৪৩ নং আয়াত ও মহানবী (সা.)-এর নিস্পাপত্ব প্রসঙ্গ

প্রশ্ন : সূরা তাওবার ৪৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে :

عَفَا اللَّهُ عَنكَ لِمَ أَذِنتَ لَهُمْ حَتىَ يَتَبَينَ َ لَكَ الَّذِينَ صَدَقُواْ وَ تَعْلَمَ الْكَاذِبِين

‘মহান আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন। সত্যবাদী ও মিথ্যাবাদীদেরকে আপনার চেনার আগেই কেন আপনি তাদেরকে অনুমতি দিলেন? (এ দুই গোষ্ঠী যাতে নিজেদের স্বরূপ প্রকাশ করে সেজন্য যদি আপনি একটু ধৈর্য্য ধরতেন এবং তাদেরকে অনুমতি দিতে বিলম্ব করতেন তাহলে তা ভালো হতো।)

প্রশ্ন সংক্রান্ত বিশদ বিবরণ : এ আয়াতটি ঐ সব মুনাফিকের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছিল যারা তাবুক যুদ্ধে যোগদান করতে চাচ্ছিল না। এ কারণেই তারা মহানবী (সা.)-এর কাছে এসে অজুহাত প্রদর্শন করে জিহাদে যোগদান না করার অনুমতি চায়। মহানবী (সা.)ও তাদেরকে ভালোভাবে চিনতেন এবং তাদের অবিশ্বাস এবং দুর্বল ঈমান সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। এ কারণেই তিনি তাদেরকে মদীনা নগরীতে থাকার অনুমতি দেন।

মহান আল্লাহ এ আয়াতে মহানবী (সা.)-কে ভর্ৎসনা করে বলেছেন : মহান আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন। আপনি কেন তাদেরকে জিহাদে যোগদান করা থেকে বিরত থাকার অনুমতি দিলেন? আপনি কেন যারা সত্যবাদী তাদেরকে মিথ্যাবাদীদের থেকে আলাদা করে চেনার এবং তাদের প্রকৃত চেহারা ও স্বরূপ উপলব্ধি করার সুযোগ দিলেন না? কেউ কেউ দাবী করেছে যে, মহান আল্লাহ তাঁর নবী (সা.)-কে এ আয়াতে ক্ষমামাখা যে তিরস্কার করেছেন তা এ বিষয়ের প্রমাণ যে, মুনাফিকদেরকে জিহাদে যোগদান থেকে বিরত থাকার যে অনুমতি তিনি প্রদান করেছিলেন তা ছিল-নাউযুবিল্লাহ-লঘু পাপ এবং মহানবী (সা.)-এর ইসমাতের (নিষ্পাপত্ব) পরিপন্থী।

আল্লামাহ যামাখশারী তাফসীর আল কাশশাফে বলেছেন :

‘মহান আল্লাহ এ আয়াতে মহানবী (সা.)-এর সমালোচনা ও তাঁর এ কাজের জন্য স্বীয় অসন্তুষ্টির কথা ব্যক্ত করেছেন। আর এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মহানবী (সা.)-এর দ্বারা পাপ সংঘটিত হয়েছিল বিধায় ক্ষমা করার প্রয়োজন হয়ে গিয়েছিল।’

উত্তর : এ আয়াতটি দুটি দিক থেকে ব্যাখ্যা করা যায় :

১. আসলে মহানবী (সা.)-এর নিকট থেকে যে কোন পাপ ও অপরাধ (মহান আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ) সংঘটিত হয়েছিল তার কোন প্রমাণই এ আয়াতে বিদ্যমান নেই। এমনকি উক্ত আয়াতে যে শব্দ পাপ ও অপরাধের অর্থ নির্দেশ করে তাও নেই। কারণ, বিদ্যমান সকল সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে স্পষ্ট হয় যে, মহানবী (সা.) স্পষ্টভাবে জানতেন যে, যদি তিনি এদেরকে (মুনাফিকদেরকে) অনুমতি না দেন এবং তাদের আবেদন মঞ্জুর না করেন তাহলেও তারা জিহাদে অংশগ্রহণ করবে না। অধিকন্তু, এই সূরার এ আয়াতের পরবর্তী আয়াতসমূহ বিবেচনায় আনলে স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, মহান আল্লাহও তাদের জিহাদে অংশগ্রহণ করার বিষয়টি পছন্দ করেন নি। কারণ, যুদ্ধে এসব মুনাফিকের উপস্থিতি অন্য সকল মুজাহিদের মনোবল দুর্বল হওয়ার কারণ হতো। মহান আল্লাহ এ সূরার ৪৭ নং আয়াতে বলেন:

لَوْ خَرَجُواْ فِيكمُ مَّا زَادُوكُمْ إِلَّا خَبَالًا وَ لَأَوْضَعُواْ خِلَالَكُمْ يَبْغُونَكُمُ الْفِتْنَةَ وَ فِيكمُ ْ سَمَّاعُونَ لهُمْ  وَ اللَّهُ عَلِيمُ بِالظَّلِمِينَ

‘যদি তারা (মুনাফিকরা) তোমাদের সাথে (জিহাদে যোগদান করার জন্য) বের হতো তাহলে তারা অস্থিরতা ও দোদুল্যমানতা ছাড়া তোমাদের মধ্যে আর কিছুই বৃদ্ধি করত না এবং অতিদ্রুত তোমাদের মধ্যে ফেতনা (মতবিরোধ ও নিফাক) ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করত এবং তোমাদের মাঝে বেশ কিছু দুর্বল চিত্তের লোক বিদ্যমান যারা তাদের কথায় বেশি বেশি কর্ণপাত করে; আর মহান আল্লাহও যালেমদেরকে ভালোভাবে চেনেন।’

আল্লামা তাবাতাবাঈ বলেছেন : ‘সংশ্লিষ্ট যাবতীয় কল্যাণ ও ক্ষতি বিবেচনা করলে মহানবী (সা.)-এর গৃহীত নীতিই ছিল প্রকৃতপ্রস্তাবে যথার্থ ও যুক্তিসংগত। তাই আল্লাহ স্বয়ং মুনাফিকদের আগমনকে অপছন্দ করেছেন ও বলেছেন :

وَ لَوْ أَرادُوا الْخُرُوجَ لَأَعَدُّوا لَهُ عُدَّةً وَ لكِنْ كَرِهَ اللَّهُ انْبِعاثَهُمْ فَثَبَّطَهُمْ وَ قِيلَ اقْعُدُوا مَعَ الْقاعِدِينَ"

‘তারা যদি (জিহাদের উদ্দেশে) বের হওয়ার সংকল্প করত, তবে তার জন্য উপকরণ সংগ্রহ করত। কিন্তু আল্লাহ তাদের বের হওয়ার প্রেরণাকেই অপছন্দ করেছেন, ফলে তাদের ফিরিয়ে রাখলেন; এবং (যেন তাদের) বলা হলো, তোমরা উপবেশনকারীদের সাথে বসে থাক।’

ইত্যবসরে, মহানবী (সা.)-এর এ অনুমতি প্রদান করার ফলে মুসলমানদের কোন কল্যাণ ও স্বার্থই বিপন্ন হয় নি, তবে মহানবী (সা.) যদি মুনাফিকদেরকে (যুদ্ধে যোগদান থেকে বিরত থাকার) অনুমতি না দিতেন তাহলে তাদের চেহারা ও স্বরূপ আরো আগেই প্রকাশিত হয়ে যেত এবং জনগণও তাদেরকে আরো আগেই চিনে ফেলত। কিন্তু আল্লাহই তা চান নি। এ কারণেই (এ অনুমতি প্রদান করে) মহানবী (সা.) কোন পাপ বা অপরাধ করেন নি এবং এ ধরনের অনুমতি প্রদান আসলে তাঁর ইসমাতের মোটেও পরিপন্থী নয়।

২. মহান আল্লাহ এ আয়াতে এক মনোজ্ঞ ও ইঙ্গিতপূর্ণ ভাষাশৈলীতে ফেতনা সৃষ্টিকারীদের পরিচিতি তুলে ধরেছেন এভাবে- হে নবী! আপনি যদি অনুমতি না দিতেন তাহলে তাদের আসল চেহারা ও প্রকৃত স্বরূপ আরো ভালোভাবে ও আরো আগে স্পষ্ট হয়ে যেত। আসলে মহান আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন (عَفَا اللَّهُ عَنك), আল্লাহ আপনার ওপর দয়া করুন (رحمک الله) এবং আল্লাহ আপনাকে সাহায্য করুন (ساعدک الله)-এর ন্যায় বাক্যগুলো আল্লাহ পাকের অপার দয়া ও করুণার পরোক্ষ ইঙ্গিত মাত্র।

যেমন আমরা বলি : খোদা তোমার মঙ্গল করুন, দেখেছ তুমি কি করেছ? আসলে এ ধরনের উক্তি সহানুভূতি, স্নেহ -ভালোবাসা ও মমতা প্রকাশের নিমিত্তেই হয়ে থাকে। যেমন : খলিফা মুতাওয়াক্কিল একজন কবিকে নির্বাসন দেয়ার জন্য নির্দেশ দিলে সে খলিফাকে বলেছিল : মহান আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন। আপনার ক্ষমা যদি আমাদের থেকে দূরে চলে গিয়ে থাকে তাহলে এমন কোন সম্মান ও মর্যাদা কি আমার ও আপনার মাঝে বিদ্যমান নেই যা তা (আপনার ক্ষমা) পুনরায় ফিরিয়ে আনবে।

৩. এটা স্পষ্ট যে, কবি ‘আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন’- এ বাক্যের মাধ্যমে মুতাওয়াক্কিল যে পাপ করেছে তা বলতে চায় নি। কারণ, এ কথার উদ্দেশ্য যদি খলিফা মুতাওয়াক্কিলের অন্যায় ও দোষ প্রকাশ হত তাহলে খলিফা আরও বেশি রাগান্বিত ও ক্রুদ্ধ হত।

৪. ‘আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন। আপনি কেন তাদেরকে অনুমতি দিলেন’- সূরা তওবার ৪৩ নং আয়াত সংক্রান্ত খলিফা মামুনের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ইমাম রেযা (আ.) বলেছিলেন, ‘এ আয়াতটি  اياک اعني و اسمعي يا جاره যদিও তোমাকে বলছি, কিন্তু আমার উদ্দেশ্য হল : হে তার প্রতিবেশী! তুমি শুনো- এই প্রবাদ বাক্যের মতই। এখানে যদিও মহান আল্লাহ তাঁর নবীকেই সম্বোধন করেছেন, কিন্তু আসলে এ কথার উদ্দেশ্য তাঁর উম্মত। তাই আয়াতে নবীর প্রতি তাঁর শুভদৃষ্টি বহাল আছে। পবিত্র কোরআনের আরও কিছু আয়াতও একইরূপ বাচনরীতি ও ধারায় অবতীর্ণ হয়েছে। যেমন : সূরা যুমারের ৬৫ নং আয়াত :

لَئنِ ْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَ لَتَكُونَنَّ مِنَ الخْاسِرِينَ

‘যদি আপনি আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থাপন (শির্ক) করেন তাহলে আপনার আমল অবশ্যই বরবাদ হয়ে যাবে এবং আপনি অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবেন।’

যদিও উপরিউক্ত আয়াতে আল্লাহ তাঁর রাসূলকে অংশীদার স্থাপনের কারণে তাঁর আমল বিনষ্ট ও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা বলছেন, কিন্তু নিঃসন্দেহে বলা যায়, তিনি কখনই এমন কাজ করতে পারেন না। তাই আয়াতে উল্লিখিত নির্দেশ তাঁর মাধ্যমে তাঁর উম্মতকে দেয়া হয়েছে, তাঁকে নয়। তেমনি ‘মহান আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন’- এ বাক্যটির মাধ্যমে মুনাফিকদের সমালোচনা করা হয়েছে এবং মহানবী (সা.)-এর প্রতি মহান আল্লাহর অপার কৃপা ও দয়ার কথা ব্যক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ এ আলোচনার ফল হল : এ আয়াতটিতে কোনভাবেই মহানবী (সা.) কর্তৃক পাপ সংঘটিত হওয়া ও মুসলিম উম্মাহর কোন ক্ষতিসাধনের কথা বর্ণিত হয় নি। ‘মহান আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন’- এ বাক্য দ্বারা মহানবী (সা.)-এর প্রতি মহান আল্লাহর অশেষ ও অপার কৃপা, রহমত ও দয়ার কথাই ব্যক্ত করা হয়েছে; আর মহানবী (সা.)-এর পাপ ও স্খলনের বিষয় এ আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় না।

অধিক অধ্যয়নের জন্য নিম্নোক্ত গ্রন্থাদি দ্রষ্টব্য

১. আয়াতুল্লাহ জাফার সুবহানী প্রণীত মানশূরে জভীদ, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৮৩।

২. আয়াতুল্লাহ হাদী মা’রেফাত প্রণীত তানযীহুল আম্বিয়া।

সমাপনী হাদীস

মহানবী (সা.) বলেছেন :

‘নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে মুত্তাকী-পরহেজগার এবং আল্লাহর ব্যাপারে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী হচ্ছি আমি।’ 

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

রমজানের ফজিলত ও গুরুত্ব
অবিকৃত গ্রন্থ আল-কোরআন
ইমাম রেজা (আ.)'র কয়েকটি অলৌকিক ঘটনা
কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনা : একটি ...
Protest einer Antikriegsgruppe gegen Luftangriff Amerikas auf ein Krankenhaus
খলিফা নির্বাচনের পদ্ধতি
‘বাতিলের মুকাবিলায় ঐক্যই ...
অর্থসহ মাহে রমজানের ৩০ রোজার দোয়া
কোরআন ও চিকিৎসা বিজ্ঞান
শিয়াদের মৌলিক বিশ্বাস (পর্ব-১)

 
user comment