বাঙ্গালী
Friday 29th of March 2024
0
نفر 0

ইসলামের দৃষ্টিতে কর্ম ও শ্রম (৩য় পর্ব)

ইসলামের দৃষ্টিতে কর্ম ও শ্রম (৩য় পর্ব)

ইসলামের দৃষ্টিতে কাজের গুরুত্ব এবং নবী-রাসূলগণসহ আল্লাহর প্রিয় অলি-আওলিয়াগণ যে সবসময় কাজ করেছেন এবং কাজ করাকে ইবাদাত বলে গণ্য করেছেন সে সম্পর্কে আমরা বিগত আসরগুলোতে খানিকটা কথা বলেছি। আজকের আসরে কাজ করার ক্ষেত্রে আল্লাহর ওপর নির্ভর করার গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিয়ে কিছু কথা বলার চেষ্টা করবো।
আল্লাহর ওপর নির্ভর করার মানে এই নয় যে,মানুষ তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার জন্যে আল্লাহর দেওয়া শক্তিমত্তা আর বস্তুগত সুযোগ-সুবিধাগুলোকে কাজে না লাগিয়ে বসে থাকবে। বরং এর অর্থ হলো একজন মুমিন আল্লাহর ওপর নির্ভর করবে এবং তাঁর ওপর আস্থা ও ভরসাকে অন্য সবকিছুর ওপর অগ্রাধিকার দেবে। সূরা আল-ইমরানের ১৫৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ ‘এবং কাজে কর্মে তাদের-অর্থাৎ মুসলমানদের-সাথে পরামর্শ করুন। এরপর যখন কোনো কাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলেন,তখন আল্লাহ তা'আলার ওপর ভরসা করুন! কেননা আল্লাহ তাওয়াক্কুল কারীদের ভালবাসেন'। এ আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নবীজীকে বলছেন যে, পর্যালোচনার ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি প্রস্তুত করার পর আল্লাহর ওপর ভরসা করে কাজ বাস্তবায়ন করুন। বিশিষ্ট চিন্তাবিদ প্রফেসর মূর্তযা মোতাহহারি এ সম্পর্কে বলেছেনঃ ‘ভরসার একটা জীবন্ত তাৎপর্য রয়েছে। তাহলো কোরআন যখনই চায় মানব জাতিকে কাজ বা আমল করার ব্যাপারে বাধ্য করতে,তখনই মানুষের মন থেকে ভয়-ভীতিগুলো দূর করার জন্যে আল্লাহর ওপর ভরসা করতে বলে। বলেঃ অগ্রসর হও! চেষ্টা করো'! তাওয়াক্কুলের প্রকৃত তাৎপর্য হচ্ছে পরিপূর্ণ আস্থা, বিশ্বাস এবং ভরসা কেবল তার স্রষ্টার ওপরই করা উচিত। এ অবস্থায় পার্থিব জগতের সকল বস্তুরও সহায়তা নেওয়া উচিত কেননা বস্তুজগতের সকল উপায় উপকরণ আল্লাহর অধীন।একইভাবে ভরসাকারী ব্যক্তির জানা উচিত,বস্তু জগতের সকল উপায় উপকরণও আল্লাহর ইচ্ছায় নিয়ন্ত্রিত এবং সেগুলো মানুষের সেবায় নিয়োজিত। এমতাবস্থায় আল্লাহর ওপর ভরসা করার ফলে কাজকর্ম ছেড়ে অলস বেকার জীবনযাপন করার কোনো কারণ কিংবা সুযোগ নেই।
পবিত্র কোরআনে ‘জুলকারনাইনের' গল্পে আমরা লক্ষ্য করবো, তিনি আল্লাহ প্রদত্ত বস্তুজাগতিক সকল সুযোগ সুবিধার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও জুলুম নির্যাতনের মূলোৎপাটন করার কাজে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন। জনগণ শত্রুদের অর্থাৎ ইয়াজুজ মাজুজের অত্যাচার নিপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে গিয়ে জুলকারনাইনের কাছে আবেদন জানায়।আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জুলকারনাইন শত্রুদের মোকাবেলায় শক্তিশালী একটি প্রাচীর নির্মাণ করেন। প্রাচীরটি নির্মাণ করেছিলেন লোহার টুকরো দিয়ে। এরপর ইয়াজুজ ও মাজুজ তার উপরে আর আরোহণ করতে পারল না এবং তা ভেদ করতেও সক্ষম হল না। যুলকারনাইন বস্তুজাগিতক সকল উপায় উপাদান ব্যবহার করে প্রাচীর নির্মাণ করার পরও বললেনঃ ‘এটা আমার পালনকর্তার পক্ষ থেকে একটা অনুগ্রহ'। এর মানে হলো সকল সুযোগ সুবিধা, সকল উপায় উপকরণ আল্লাহই আমাকে দিয়েছেন। সূরা কাহাফে এর বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে।
মানুষ প্রায়ই বিভিন্ন কাজ বাস্তবায়নের জন্যে কর্মসূচি প্রণয়ন করে বা পরিকল্পনা গ্রহণ করে। পরিকল্পনার ভেতর বাহির সুবিধা অসুবিধাগুলো ভালোভাবে পর্যালোচনা করে বাহ্যত তা বাস্তবায়নের পথে কোনোরকম বাধা বা সমস্যা না থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েই কাজ শুরু করে। অথচ দেখা যায় একটা সাধারণ কোনো ঘটনার কারণে তাদের সকল পরিকল্পনাই উলট পালট হয়ে যায় এবং তাদের কাজ ফলাফলশূণ্য হয়ে পড়ে। এর কারণটা হলো মানুষের জ্ঞান সীমিত, তাই সে সম্ভাব্য সমস্যা সম্পর্কে অবহিত নয়। তাছাড়া মানুষ যখন কাজ করা বা কাজ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন সে ঠিক জানে না কোনটাতে তার কল্যাণ নিহিত। ধর্মীয় দৃষ্টিতে মানুষ আশাবাদী বাস্তবতার সম্মুখিন হয় এই চিন্তা করে যে সৃষ্টিজগতের একজন পালনকর্তা রয়েছেন,যার জ্ঞান,যার শক্তি এবং যার কৌশল সীমাহীন। তিনি বান্দাদের সকল কাজ আঞ্জাম দেওয়ার সামর্থ রাখেন এবং বান্দাদের প্রকৃত কল্যাণ সম্পর্কে জানেন। এরকম একজন পালনকর্তার ওপর ভরসা করে মানুষ মূলত সীমাহীন এক শক্তির সাথে সম্পর্কসূত্র নির্মাণ করে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে সে তার কাজকর্মে আল্লাহর শক্তির দীপ্তি দেখতে পায়।
আল্লাহর ওপর ভরসা করার তাৎপর্য সম্পর্কে বিশিষ্ট চিন্তাবিদ মরহুম আল্লামা সাইয়্যেদ হোসাইন তাবাতাবায়ি বলেছেনঃ ‘মানুষ অনেক সময় তার লক্ষ্যে পৌঁছার জন্যে প্রস্তুতি নেয় এবং প্রয়োজনীয় সকল শক্তি-সরঞ্জামও প্রস্তুত রাখে। কিন্তু আত্মিক বা মানসিক কিছু বিষয় যেমন ইচ্ছাশক্তির দৃঢ়তাহীনতা, ভয়ভীতি, অভিজ্ঞতার স্বল্পতা,উৎকণ্ঠা ইত্যাদি তার এবং তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করে। এরকম অবস্থায় মানুষ যদি আল্লাহ সুবহানের ওপরে ভরসা করে তাহলে আর ইচ্ছা এবং সংকল্পগুলো দৃঢ় ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। যারফলে মানসিক সকল বাধা-প্রতিবন্ধকতা, মানসিক সকল দুর্বলতা কেটে যায় এবং নির্ভরতার মাধ্যমে আল্লাহর সাথে যোগসূত্র স্থাপিত হবার ফলে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার আর কোনো কারণ থাকে না'। আল্লাহর ওপর ভরসা করলে মানুষের ভেতর পদক্ষেপ নেওয়া এবং তা বাস্তবায়ন করার একটা শক্তি-সাহস সৃষ্টি হয় যার কারণে চিন্তা-চেতনা কিংবা আচার আচরণে সর্বপ্রকার প্রতিবন্ধকতা দূর হয়ে যায়। আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ আস্থাবান ব্যক্তি তার লক্ষ্যে পৌঁছার জন্যে যেসব উপায় উপকরণকে কাজে লাগায় সেসবের মাধ্যমে কিংবা অন্য কোনো পন্থায় আল্লাহ তাকে তার উদ্দেশ্য সফল করিয়ে দেবেন বলে বিশ্বাস করে।
এজন্যে তাওয়াক্কুল মানে এমনটি ভাবা ঠিক নয় যে মানুষ কেবল ইবাদাত বন্দেগিতে মশগুল থেকে আল্লাহর কাছে নিজের চাওয়া পাওয়ার কথা অভাব অভিযোগের কথা বলেই ক্ষান্ত হবে, কাজকর্ম আর করবে না। বর্ণনায় এসেছে যে পয়গাম্বর (সা) একটি দলকে দেখতে পেলেন যারা কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে বেকার বসে আছে। নবীজী তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘তোমরা তোমাদের জীবন জীবিকা কীভাবে নির্বাহ করো'? তারা বললোঃ আমরা আল্লাহর ওপর ভরসাকারী লোক। তাদের এই জবাব শুনে নবীজী বললেনঃ ‘তোমরা আল্লাহর ওপর ভরসাকারী নও বরং সমাজের বোঝা'। হিজরি দ্বিতীয় শতকে মুসলমানদের মাঝে যখন চিন্তাদর্শগত বিচ্যুতি দেখা দিয়েছিল,তখন একদল বলতো যে কাজকর্ম করাটা পার্থিব স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়, তাই তা ঈমান,তাকওয়া বা ধার্মিকতার সাথে সাংঘর্ষিক।
অথচ ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হলো পৃথিবীর প্রতিটি বস্তু আল্লাহর নিয়ামত এবং সেগুলো মানুষের উপকারেই আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন,তাদের জন্যে হালাল করেছেন। তবে শর্ত হলো আল্লাহ প্রদর্শিত পন্থায় সেগুলোকে কাজে লাগাতে হবে এবং আল্লাহর পথে ব্যয়ও করতে হবে। তাহলে সেগুলো হবে নৈতিক এবং আত্মিক পূর্ণতার উপায়। নবীজী এবং তাঁর আহলে বাইত ইবাদাততুল্য কাজকর্মের মধ্য দিয়ে মানুষের জন্যে তার নিদর্শন রেখে গেছেন।
সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হলো কাজকর্মে একে অপরকে সাহায্য সহযোগিতা করা। প্রকৃতপক্ষে মানুষের জীবনচক্রের প্রবাহটাই সামষ্টিক এবং পরস্পরের প্রতি সহযোগিতামূলক। হযরত আলী (আ) মানুষের মাঝে সৃষ্টিগত তারতম্যের কারণ হিসেবে একে অপরের সেবায় এগিয়ে আসার কথা উল্লেখ করেছেন। এ বক্তব্যের ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেনঃ ‘কোনো মানুষের জন্যেই স্থপতি, কাঠমিস্ত্রি, শিল্পশ্রমিক নিজের একার পক্ষে হওয়া সম্ভব নয় এবং অন্যদেরকে কাজে নিয়োজিত না করে সকল কাজ একার পক্ষে আঞ্জাম দেওয়াও অসম্ভব'। নিঃসন্দেহে যখন লোকজন একই রকম জীবন পদ্ধতি এবং একই স্তরের মেধা চর্চা করে কিংবা সামাজিক অবস্থানও যদি একই পর্যায়ের হয় তাহলে পরস্পরকে সেবা দেওয়ার প্রক্রিয়ায় গোলমাল দেখা দেয়। কেননা লোকজন একইরকম যোগ্যতার অধিকারী হলে পরস্পরকে তেমন একটা প্রয়োজন পড়ে না,যারফলে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সহযোগিতার কোনো অর্থ থাকে না।
ঠিক যেমনি মানব দেহের কোষগুলো যদি নির্মাণ কাঠামো এবং কার্যদক্ষতার দিক থেকে একইরকমের হতো তাহলে মানবদেহের ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা দেখা দিতো। দেহকোষগুলো তাই প্রত্যেকেই ভিন্ন ভিন্ন এবং নির্দিষ্ট কাজে নিয়োজিত। তেমনিভাবে মানুষের মধ্যেও প্রত্যেকটি দল একেকটি নির্দিষ্ট সুযোগ সুবিধা এবং মেধা ও যোগ্যতার অধিকারী,তাই তারা নিজেদের মেধা ও যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে অন্যদের সহযোগিতা করতে পারেন। মানুষের মাঝে দায়িত্ব বণ্টনের ব্যাপারে পবিত্র কোরআনের সূরা যুখরুফের বত্রিশ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ
‘তারা (অর্থাৎ কাফেররা) কি আপনার পালনকর্তার রহমত বন্টন করে? আমরা তাদের মধ্যে তাদের জীবিকা পার্থিব জীবনে বন্টন করেছি এবং একের মর্যাদাকে অপরের উপর উন্নীত করেছি যাতে একে অপরের অধীনে থেকে পরস্পরকে সহযোগিতা করে। তারা যা সঞ্চয় করে,আপনার পালনকর্তার রহমত তারচেয়ে অনেক উত্তম'। তবে এই তরতম্যের কারণে মানুষকে শোষণ করার কোনো অজুহাত দাঁড় করানো ঠিক নয়। কারণ ইসলামে শ্রমিকদের অধিকার এবং তাদের নিয়োগের ব্যাপারে সামগ্রিক নীতিমালা রয়েছে।
সূরা কাসাসে বর্ণিত হয়েছে,হযরত মূসা (আ) নির্দিষ্ট পারিশ্রমিকের বিনিময়ে হযরত শুয়াইব (আ) এর অধীনে কাজ করতে রাজি ছিলেন। সূরা কাহাফে খিযির (আ) এর সাথে মূসা (আ) এর সঙ্গ দেওয়ার কাহিনীও বর্ণিত হয়েছে। সেখানেও তিনি পারিশ্রমিকের বিনিময়ে শ্রম দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। একইভাবে ‘জুলকারনাইন'কে অনেকেই প্রাচীর নির্মাণের জন্যে পারিশ্রমিক গ্রহণ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কর্মনীতির দৃষ্টিতে শ্রমিক হলো সে-ই যে নিয়োগদাতার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে শ্রম দেয়। শ্রমিকেরা হলেন সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণীর লোক, কেননা যে-কোনো দেশের অর্থনীতির চাকা শ্রমিকদের শ্রম ও শক্তির বলেই সচল থাকে।শ্রমিক শ্রেণীই তাদের বাহুবলের সাহায্যে কাজ করে অর্থনৈতিক কর্মসূচিগুলোকে বাস্তবায়ন করতে সহযোগিতা করে।
আর শ্রমিকেরা এই যে শ্রম দেয় তার কারণ হলো পারিশ্রমিক।এই পারিশ্রমিক দিয়েই তারা জীবিকা নির্বাহ করে। নিয়োগদাতাগণের দায়িত্ব হলো শ্রমিকদেরকে উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিয়ে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা যাতে শ্রমিকের যথার্থ কল্যাণ হয় এবং মানসিক প্রশান্তি আসে।এটা নিশ্চিত হলে শ্রমিকেরাও ভালো এবং বেশি কাজ করবে।মানসিক প্রশান্তি সম্পর্কে ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর একটি হাদিসে বর্ণিত আছে,তিনি বলেছেনঃ ‘কোনো ব্যক্তির জীবন জীবিকার উপায় উপকরণ যখন চাহিদা অনুযায়ী নিশ্চিত হয় তাহলে তার মানসিক অবস্থা প্রশান্ত হয়'।
ইসলামে একজন শ্রমিক এবং নিয়োগদাতার মধ্যে সম্পর্ক হলো সহকর্মী এবং অংশীদারিত্বের সম্পর্ক। ইসলামের দৃষ্টিতে একজন শ্রমিক এবং একজন নিয়োগদাতার মধ্যকার আচার ব্যবহার হতে হবে বিশ্বস্ততা,আন্তরিকতা ও সম্মানের ভিত্তিতে।নবী কারিম (সা), হযরত আলী (আ)সহ অন্যান্য ইমামগণ সবসময় কারিগরদের যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়েছেন এবং তাদের অধিকার রক্ষায় সদাসচেষ্ট ছিলেন। নবীজী বলেছিলেনঃ শ্রমিকের ব্যাপারে নিয়োগদাতার করণীয় হলো তাকে ভালো খাবার এবং পোশাক দিতে হবে এবং সাধ্যের অতীত কাজ তার ওপর চাপানো যাবে না'। নবীজী আরো বলেছেনঃ ‘তোমরা সবাই তোমাদের অধীনস্থদের ব্যাপারে দায়িত্বশীল। যে-ই শ্রমিকদের পারিশ্রমিক দেওয়ার ব্যাপারে জুলুম করবে, আল্লাহ তার নেক আমলগুলো নষ্ট করে দেবেন এবং সে বেহেশতের মনোমুগ্ধকর সুঘ্রাণ থেকে বঞ্চিত হবে'। আহলে বাইতের মহান ইমাম হযরত সাজ্জাদ (আ)ও শ্রমিকদের ব্যাপারে সদয় এবং ন্যায়বান হওয়া এবং তাদের ভুলত্রুটিগুলোকে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।একইভাবে শ্রমিকদের ওপর অত্যাচার করতে নিষেধ করেছেন।
ইমাম সাজ্জাদ (আ) আরো বলেছেনঃ যে ব্যক্তিটি তোমার কাজগুলো আঞ্জাম দিচ্ছে তার অধিকারের ব্যাপারে তোমার জেনে রাখা উচিত ঐ শ্রমিকও তোমার মতোই আল্লাহর সৃষ্টি এবং প্রকৃতপক্ষে তোমার আদি পিতা-মাতা অর্থাৎ আদম এবং হাওয়া (আ) এরই উত্তরসূরি।তুমি তার স্রষ্টাও নও মালিকও নও এবং তার রুযিও তোমার হাতে নয়। তাই তুমি তার সাথে সদাচরণ করো এবং তাকে নির্যাতন করো না'। সবশেষে ইমাম রেযা (আ) এর জীবনের একটি বর্ণনা বিশেষ করে শ্রমিকদের অধিকার আদায় সংক্রান্ত একটি বর্ণনা দেওয়ার মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্তি টানবো আজকের আলোচনার। সোলায়মান নামের এক লোক ইমাম রেযা (আ) এর সাথে সঙ্গ দেওয়ার এক দিনের একটি স্মৃতি সম্পর্কে বলেছেনঃ
‘সেদিন আমার সৌভাগ্য হয়েছিলো ইমামকে তাঁর ঘর পর্যন্ত সঙ্গ দেওয়ার। ইমাম রেযা (আ) এর ঘরের দরোজায় পৌঁছলাম। বিদায় চাইতে গেলে ইমাম তাঁর ঘরে আমাকে আমন্ত্রণ জানালো। আমি ভীষণ খুশি ও আগ্রহ ভরে ইমামের আমন্ত্রণ গ্রহণ করলাম এবং ঘরের ভেতর ঢুকলাম। বাসায় তখন বেশ কজন শ্রমিক কাজ করছিলো। তারা ইমামকে দেখেই কাজ রেখে তাঁর কাছে এসে সালাম করলো। ইমামের ঘর ছাড়া আর কোথাও শ্রমিকেরা তাদের নিয়োগদাতাকে দেখে এই পরিমাণ উৎফুল্ল হতো না। ইমাম রেযা (আ) মুচকি হেঁসে তাদের সালামের জবাব দেন। এমন সময় ইমামের নজর পড়ে অপরিচিত এক শ্রমিকের ওপর।ইমাম তার সম্পর্কে জানতে চাইলেন কে ও! জবাব এলো নতুন শ্রমিক, সম্প্রতি তাদের দলে ভিড়েছে।ইমাম জানতে চাইলেন তার পারিশ্রমিক ঠিক করা হয়েছে কিনা। জবাব দিলো-‘না!তাকে যা-ই দেন তা-ই নেবে'।
দেখলাম এ কথা শুনে ইমামের চেহারাটা কেমন যেন পরিবর্তন হয়ে গেল। মনে হলো যেন বিরক্ত হলেন এবং উঠোনের দিকে চলে গেলেন।আমি জিজ্ঞেস করলাম-হে ইমাম! কেন রাগ করলেন! ইমাম বললেনঃ বহুবার তাদেরকে বলেছি যে নতুন কোনো শ্রমিক এলে আগে তার পারিশ্রমিক ঠিক করে নেবে। চুক্তি বা কথাবার্তা ছাড়া কাজ করলে তাকে তিন গুণ বেশি পারিশ্রমিক দিলেও ভাবে কম দেওয়া হয়েছে। আর চুক্তি অনুযায়ী পারিশ্রমিক দিলে তা পেয়ে খুশি হয়ে যায়, তারচেয়ে খানিকটা বেশি দিলে বখশিস হিসেবে নিয়ে আরো খুশি হয়'।‘ তো এই হলো শ্রমিকদের ব্যাপারে ইসলামের নীতিমালা।
নিঃসন্দেহে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ শক্তিগুলোর একটি হচ্ছে কর্মপ্রচেষ্টা। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বিকাশে মানব সম্পদের অবস্থান বর্তমানে অর্থনীতির ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়। মূলত বিভিন্ন দেশের সক্ষমতা বা উন্নয়নের প্রধান উপায়ই হলো কর্মপ্রচেষ্টা। যে দেশ বা জাতি যতো বেশি কর্মতৎপরতা চালাবে সে জাতি অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে ততো বেশি সক্ষম হবে। হযরত আলী (আ) সুন্দর একটি বাক্যে বলেছেনঃ ‘যারা কর্মপ্রচেষ্টা চালায় তারাই উন্নতি ও অগ্রগতি লাভ করে,জ্ঞানী বেকাররা নয়'। তাঁর এ বক্তব্যের মানে হলো একটি সমাজ তখনই উন্নতি লাভ করে যখন সেই সমাজের জ্ঞানী-গুণীজনেরা আন্তরিকতার সাথে চেষ্টা প্রচেষ্টা চালায়, কাজ করে। কারণটা হলো জ্ঞান ও প্রজ্ঞাগুলোকে বাস্তবে কাজে লাগানো হলেই কেবল তা ফল দেয়।
যেমনটি বলেছিলাম যে কাজ এবং চেষ্টা প্রচেষ্টার ওপরই জীবনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত,আর ব্যক্তি ও সমাজের মনোদৈহিক সুস্থতাও নির্ভর করে সুস্থ অর্থনীতি আর জীবিকার ওপর। সেজন্যে একটি সমাজের প্রতিটি নাগরিকের উচিত সামাজিক যৌথ কর্মকাণ্ড ও সেবামূলক কাজসহ পণ্য সামগ্রী উৎপাদনের ক্ষেত্রেও গ্রহণযোগ্য পর্যায়ের ভূমিকা রাখা। যে সমাজে কর্মচাঞ্চল্য যতো বেশি হবে সে সমাজে পণ্য সামগ্রী উৎপাদনের পরিমাণও ততোবেশি হবে-এটাই স্বাভাবিক,আর এই উৎপাদন প্রাচুর্যের কারণে সেই সমাজের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতিও বৃদ্ধি পাবে। অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কর্মপ্রচেষ্টার মাধ্যমে ব্যক্তির খাওয়া-পরার চাহিদা যেমন মেটে তেমনি সামাজিক অবস্থানও তৈরি হয়। তবে ইসলামী সংস্কৃতির শিক্ষা হলো জনগণকে সামষ্টিক প্রচেষ্টা বা গণ অংশগ্রহণের দিকে আহ্বান জানানো। কর্মপ্রচেষ্টার ক্ষেত্রে কেবল ব্যক্তিগত স্বার্থ চিন্তা না করে সামাজিক স্বার্থ চিন্তা করার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করে ইসলাম। এরকম চিন্তা করা হলে বা দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা হলে সমাজে সংহতির একটা প্রাণময় আবহ তৈরি হয়।
ইসলামের চিন্তাদর্শ অনুযায়ী উন্নয়নের মূলে রয়েছে প্রধানত মানুষ। তাই যে সমাজের মানুষের মেধা ও প্রতিভা যতো বেশি কাজে লাগে সে সমাজে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ততো বেশি উন্নয়ন অর্জিত হয়। যেহেতু মানুষ হচ্ছে একটি সমাজের সম্পদ, তাই সমাজের বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক লক্ষ্য অর্জনের জন্যে পারস্পরিক সহযোগিতার বিকল্প নেই। সবাই সবাইকে সহযোগিতা করার মধ্য দিয়ে যে পণ্যসামগ্রী উৎপাদিত হয় সেই পণ্যের ব্যবহার করার অধিকার তাই সবারই থাকে। মরহুম অধ্যাপক মোতাহহারী (রহ) এ সম্পর্কে বলেছেন, ‘আসলে কাজ হচ্ছে একটা সামাজিক দায়িত্ব আর মানুষের ওপর সমাজের একটা অধিকার রয়েছে। একজন ব্যক্তি যতোটুকুই খরচ করেন সেটুকু অন্যদের কাজের ফসল। আমরা যেই জামাকাপড় পরি,যেসব খাদ্যখাবার খাই, যেই জুতা পায়ে দেই এবং যে বাসায় বসবাস করি-এভাবে যে দিকেই তাকাই না কেন,সবই অন্যদের কর্মপ্রচেষ্টার ফল'।
সেজন্যে সমাজের সাথে মানুষের সম্পর্ক সৃষ্টি এবং সেই বন্ধনকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে কাজের ভূমিকা অপিরসীম। সামাজিক এই সম্পর্ক হলো উন্নয়নের জন্যে সমাজের সদস্যদের চেষ্টা প্রচেষ্টার চালিকাশক্তি। সমাজের যেমন ব্যক্তিকে প্রয়োজন তেমনি ব্যক্তিরও প্রয়োজন পড়ে সমাজের। উভয়ের প্রতি উভয়ের দায়িত্ব রয়েছে। ব্যক্তির প্রয়োজনীয়তা মেটানোর দায়িত্ব যেমন সমাজ বা সামাজিক দলগুলোর রয়েছে ঠিক তেমনি ব্যক্তিরও রয়েছে সমাজের চাহিদা মেটানোর দায়িত্ব। এভাবেই পারস্পরিক সম্পর্ক ব্যক্তি এবং সমাজের পরস্পরের মধ্যে যোগসূত্র সৃষ্টি করে, যার ফলে প্রতিষ্ঠিত হয় সামাজিক ঐক্য ও সংহতি।
সমাজের সকল শ্রেণীর জন্যে কাজ ও পেশা সৃষ্টির মাধ্যমে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত ও বাস্তবায়িত হয়। ইসলামে ‘ন্যায়' বলতে বোঝায় সবাইকে সমান সুযোগ দেওয়াকে। কাজ বা পেশা যদি যথাযোগ্য না হয়,অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের আদর্শ যদি দুর্বল এবং বেকারত্বপূর্ণ হয় অথবা কাজের স্বল্পতা থাকে, তাহলে সামাজিক ন্যায় বাস্তবায়িত হবে না। মাদকাসক্তি, অনিয়ম ও দুর্নীতি ইত্যাদি অভাব-অনটন আর বেকারত্বের সাথে সম্পৃক্ত। অগ্রগতিহীনতা আর অনুন্নতির পেছনে গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলোর একটি হলো কাজের স্বল্পতা এবং বেকারত্ব কিংবা কাজের নিম্নমান। ইসলাম অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সংরক্ষণ করা এবং কর্মতৎপরতার প্রতি উৎসাহিত করার মাধ্যমে চেষ্টা করেছে শ্রেণীগত বিভেদ দূর করতে। বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যাঁরা পরিচালনা করছেন তাঁরা এখন চাকুরি বা কর্মে নিযুক্তির ওপর ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েছেন। আজকাল যদিও মানুষের কাজের স্থান বহুলাংশেই দখল করেছে উন্নত প্রযুক্তি,তবু বলতেই হবে যে এই টেকনোলজি বা প্রযুক্তিও মানুষেরই আবিষ্কার।
এখন যদি কাজের ক্ষেত্র প্রস্তুত না হয় তাহলে একজন সৃজনশীল ব্যক্তি তার মেধা ও সৃজনশীলতাকে কাজে লাগানোর সুযোগ পাবে না। এজন্যেই উপযুক্ত কর্মক্ষেত্র না থাকার ফলে স্বাভাবিকভাবেই সৃজনশীলতার চর্চা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। এরই পথ ধরে মানুষ অর্থনৈতিক কল্যাণহীন কাজে জড়িয়ে পড়ে। যেমন সুদ, ঘুষ খাওয়ার কাজ কর্মে জড়িয়ে পড়ে। এভাবে গঠনমূলক কোনো কাজ না করেও ব্যাপক অর্থ-সম্পদের মালিক হয়ে যায়, যদিও অনেক ক্ষেত্রেই তা অবৈধ। পক্ষান্তরে মানুষ যখন দলে দলে ভালো ও কল্যাণজনক কাজে নিযুক্ত হয়,সমাজের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ধীরে ধীরে ঘটতে থাকে। এভাবে সমাজের অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটে এবং জাতীয় আয় ও উৎপাদনও বৃদ্ধি পায়। আর রাষ্ট্রের আয় বৃদ্ধি পেলে দেশের জনগণের সেবা বেশি বেশি করার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
একদিন ইমাম সাদেক (আ) তাঁর সঙ্গীদের একজনকে জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘কী এখন কাজ করো? লোকটি জবাব দিলোঃ ব্যবসা থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছি। ইমাম বললেনঃ ‘এরফলে তোমার সম্পদ হাতছাড়া হয়ে যাবে। ব্যবসার কাজ ছেড়ে দিও না আর আল্লাহর রহমত কামনা করো'! ইসলামের মহান মনীষীগণ যে কৃষিকাজ,ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প ইত্যাদি কাজের ওপর জোর দিয়েছেন,তা থেকেই অর্থনৈতিক উন্নয়নে কর্মপ্রচেষ্টার ভূমিকার বিষয়টি প্রমাণিত হয়ে যায়। আজকের আলোচনার পরিসমাপ্তি টানবো ইমাম আলী (আ) এর একটি বক্তব্য দিয়ে। নাহজুল বালাগার ৫২ নম্বর চিঠিতে অর্থনৈতিক বিভিন্ন দলের উদ্দেশ্যে মালেক আশতারকে লক্ষ্য করে ইমাম বলেছেন ‘ব্যবসায়ীগণ এবং শিল্পপতিদের সম্পর্কে আমার উপদেশ হলো-তাদেরকে ভালো ও কল্যাণময় কাজের প্রতি উৎসাহিত করো। চাই সেসব ব্যবসায়ী শহরের অধিবাসী হোক কিংবা সদা ভ্রাম্যমান। একইভাবে যারা কায়িক শ্রম দিয়ে কাজ করে। এরা স্বার্থ-মুনাফা ও কল্যাণের মূল উৎস'। হিজরতের পর নবীজীও কর্মক্ষেত্র সৃষ্টির জন্যে ব্যাপক প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। আমাদের জন্যে এর মধ্যে ব্যাপক শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে।(রেডিও তেহরান)

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

কুরআন ও হাদীসের আলোকে হিংসা ও লোভ
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো ...
ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রেষ্ঠ সম্পদ
তাকফিরীরা জাহান্নামের কুকুর : ...
শবে বরাত
কথায় কথায় কাফির ঘোষণা, মুসলমানরা ...
ইসলামী বিচার পদ্ধতি
ইমাম হাসান (আ) এর বেদনা বিধুর ...
ইসলামের দৃষ্টিতে কর্ম ও শ্রম (৩য় ...
ইমামীয়া জাফরী মাজহাব-শেষ পর্ব

 
user comment