বাঙ্গালী
Saturday 20th of April 2024
0
نفر 0

নৈতিকতা, ধর্ম ও জীবন: ৮ পর্ব

ইরানের মনোবিজ্ঞানী ড. গোলাম আলী আফরোজের বক্তব্য দিয়ে আজকের আসর শুরু করছি। তিনি বলেছেন, “ ধর্ম হচ্ছে কিছু বিশ্বাস এবং যৌক্তিক বিধি-বিধানের সমষ্টি, যার ভিত্তি হলো- মানুষের প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য এবং চাহিদা।” এ কারণে ধর্মপরায়নতা মানসিক সুস্থতা ও আত্মউন্নতি নিশ্চিত করে। যা কিছু স্বল্প মেয়াদে ও দীর্ঘ মেয়াদে মানুষের জ্ঞান-চেতনা এবং জৈবিক, মনস্তাত্বিক, সামাজিক ও জ্ঞানগত দিক থেকে  উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য ক্ষতিকর, ইসলাম ধর্মে তা হারাম। অন্যদিকে, যা কিছু শারীরিক, জ্ঞানগত, মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক দিক থেকে কল্যাণকর, তা হালাল হিসেবে গণ্য।” তার মতে, ঐশী মূল্যবোধ, যৌক্তিক বিধি-বিধান ও ধর্মীয় শিক্ষা, সব মানুষের মানসিক সুস্থতা, সুস্বাস্থ্য ও আত্মউন্নতির নিশ্চয়তা বিধানকারী।

 

গত অধ্যায়ে আমরা বলেছি, একত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গির ফল হচ্ছে, আল্লাহর প্রতি ঈমান। এর ফলে জীবন সম্পর্কে মানুষের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়। জীবন সম্পর্কে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করে। এর কারণ হলো, আল্লাহর প্রতি ঈমান হচ্ছে মানুষের প্রকৃতিগত ও স্বভাবগত চাহিদা। স্বাভাবিক ভাবেই  মানুষের স্বাভাবিক ও প্রকৃতিগত চাহিদাকে অস্বীকার করা হলে মানসিক সুস্থতায় বিঘ্ন ঘটে। কিন্তু আল্লাহর প্রতি ঈমানের কারণে যে আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠে,তাতে মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত হয়। ধর্মীয় শিক্ষা বিশেষকরে ইসলামি শিক্ষার প্রতি দৃষ্টি দিলে এটা সুস্পষ্ট হয় যে, ঐশী শিক্ষা মানুষকে গঠনমূলক জীবন গড়তে সহযোগিতা করে। আসলে ধর্মীয় শিক্ষার লক্ষ্য হলো- ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে উন্নতি ও গতিশীলতা সৃষ্টি করা এবং উন্নতি ও পূর্ণতার পথে বাধা দূর করা। ধর্মীয় শিক্ষায় যে বিষয়টি ব্যক্তির মনস্তাত্ত্বিক সুস্থতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে,তাহলো- হতাশ না হওয়ার শিক্ষা।

 

 ঈমানদার মানুষ আল্লাহর রহমতের বিষয়ে সব সময় আশাবাদী। কারণ আল্লাহর রহমতের বিষয়ে হতাশা হচ্ছে, মানুষের আত্মিক, মনস্তাত্ত্বিক ও নৈতিক সমস্যাসহ অনেক কিছুর উতস। একত্ববাদে বিশ্বাস এবং জীবনের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব হচ্ছে, আল্লাহর পক্ষ থেকে বড় ধরনের রহমত। জীবনের ব্যাপারে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি মানুষের জীবন প্রক্রিয়াকে সচল রাখে এবং চেষ্টা-প্রচেষ্টাকে জোরদার করে। ভবিষ্যতের ব্যাপারে হতাশ ব্যক্তি সারেঙবিহীন জাহাজের মতো। সারেঙ বিহীন জাহাজ যেমন সাগরে দিকভ্রান্ত অবস্থায় ভাসমান থাকে, তেমনি হতাশ ব্যক্তিরাও বেঁচে থাকে দিকভ্রান্ত অবস্থায়। ধর্মীয় শিক্ষায় হতাশার স্থান নেই। আসলে আশা নিয়েই বেঁচে থাকে মানুষ। তবে অলীক আশা ও স্বপ্ন কখনোই কাম্য নয়। ইসলাম ধর্মে সব কিছুতেই ভারসাম্য রক্ষার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। মানুষের জীবন হচ্ছে কাঁটাযুক্ত গোলাপে ভরা বাগানের মতো। গোলাপে কাঁটা থাকলেও সেটা কখনোই অপাক্তেয় নয়।

 

গোলাপে যে কাঁটা থাকে,তা ফুলটিকে দীর্ঘ সময় সতেজ থাকতে সহযোগিতা করে। কাউকে উপহার দিতে চাইলে কাঁটাযুক্ত গোলাপই দিতে হয়। কিন্তু কেউ কখনোই এ প্রশ্ন করে না যে, কেনো কাঁটাযুক্ত গোলাপ দেয়া হলো বরং উল্টো এ জন্য সবাই ধন্যবাদ জানায়। কারণ সবাই জানে গোলাপের সঙ্গে কাঁটা থাকবেই। ঠিক তেমনিভাবে সুখ-দুঃখ মিলিয়েই জীবন। দুঃসময়ে ধৈর্য না হারানোই মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের পরিচায়ক। যারা ইতিবাচক মনোভাবের অধিকারী, তারা দুঃখ-কষ্টকেও জীবনের স্বাভাবিক অংশ হিসেবে মেনে নেয়। তবে এর অর্থ এই নয় যে, সব কিছুর বিষয়েই স্রোতে গা ভাসিয়ে দিতে হবে। যা ইচ্ছে ঘটে যাক- এমন মনোভাব কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যে কোনো সমস্যা ও দূর্যোগ মোকাবেলায় আল্লাহর ওপর নির্ভর করে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে। সর্বাত্বক চেষ্টার পরও সমাধান না হলে ধৈর্য্য ধরতে হবে। হতাশ হলে চলবে না।

 

আসলে আল্লাহতায়ালা মানুষকে নানাভাবে পরীক্ষা করেন। অনেক সময় কঠিন রোগ-বালাই দিয়েও মানুষের ঈমানের পরীক্ষা নেন আল্লাহতায়ালা। তবে প্রতিটি কষ্টেরই শেষ আছে এবং এরপর রয়েছে প্রশান্তি। পবিত্র কুরআনের সূরা ইনশিরার ৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- “সুতারাং প্রতিটি কষ্টের সাথে অবশ্যই আছে যন্ত্রণার লাঘব।”

 

আসলে পৃথিবীর জীবনে দুঃখ-কষ্ট থাকবেই। পৃথিবীর জীবন সংগ্রামকে, দুঃখ-কষ্টকে, বাঁধা -বিপত্তিকে তখনই সঠিকভাবে মোকাবেলা করা সম্ভব, যদি আমরা আল্লাহ্‌র নির্দেশিত পথে অটল থাকি, আল্লাহ্‌র প্রতি বিশ্বাসে দৃঢ় থাকি এবং ধৈর্য্য অবলম্বন করে একমাত্র আল্লাহ্‌র উপরেই নির্ভরশীল হই। কোনো অবস্থাতেই হতাশ হলে চলবে না। এ প্রসঙ্গে ইমাম হাদি (আ.)’র জীবদ্দশার একটি ঘটনা এখানে তুলে ধরছি।

 

একদিন আবু হাশেম জাফারি নামের এক ব্যক্তি হতাশ মনে ইমামের কাছে আসলেন। ইমাম দেখলেন আবু হাশেমের অবস্থা এতটাই খারাপ যে, সে কোনো ধরনের কাজের স্পৃহা পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছে। এ অবস্থায় ইমাম হাদি (আ.) আবু হাশেমকে তার জীবনের নানা অর্জন ও প্রাপ্তির  কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। আল্লাহর নানা নেয়ামত একে একে তুলে ধরে ইমাম বললেন: হে আবু হাশেম, বলোতো আল্লাহর কোন নেয়ামতটির জন্য পরিপূর্ণভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ক্ষমতা তোমার আছে? এরপর তিনি আবারও আল্লাহর অনুগ্রহগুলো একে একে বর্ণনা করে বুঝালেন যে, আবু হাশেম যে জন্য হতাশ হয়ে পড়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি কিছুর অধিকারী আবু হাশেম। অর্থাত যা কিছু তার অধিকারে নেই, তার চেয়েও অনেক বেশি কিছু রয়েছে তার অধিকারে।

 

ধর্মে বিশ্বাসী ব্যক্তিরা যে কোনো পরিস্থিতিতে আল্লাহর ওপর আস্থা রাখেন। সব ধরনের দুঃখ-কষ্টকে বিবেচনা করেন আল্লাহর পরীক্ষা হিসেবে। আল্লাহর ওপর ঈমান, ধৈর্য্য ও অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার চেষ্টা চালায় এবং এটা বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ সব কিছু করতে পারেন ও নিজের বান্দাদেরকে অত্যন্ত ভালোবাসেন। আমরা সবাই সব ক্ষেত্রে আল্লাহর ওপর নির্ভরতা বজায় রাখতে সক্ষম হবো।

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

শিয়া মুসলমানরা কত ওয়াক্ত নামাজ ...
অষ্ট্রেলিয়ান নও-মুসলিম সুসান ...
শিয়া-সূন্নীর মধ্যে পার্থক্য কি?
সূরা আত তাওবা;(৬ষ্ঠ পর্ব)
আহলে সুন্নতের দৃষ্টিতে ...
সূরা রা’দ; (১ম পর্ব)
ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রমের মর্যাদা ...
মিথ্যা কথা বলা
আল্লাহ্‌ কেন শয়তানকে সৃষ্টি ...
মুসলমানদের প্রথম কিবলা ...

 
user comment