বাঙ্গালী
Friday 19th of April 2024
0
نفر 0

কোরবানির তাৎপর্য ও শিক্ষা

কোরবানির তাৎপর্য ও শিক্ষা



মানবজাতির ইতিহাসে পিতা-মাতা-পুত্রের চরম আত্মোৎসর্গের এরূপ দৃষ্টান্ত আর কখনো দেখা যায় না। তাই আল্লাহ মানবজাতিকে অনুপ্রাণিত করার উদ্দেশ্যে এ চরম ও অত্যুজ্জ্বল আত্মোৎসর্গের স্মৃতিকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছেন ঈদুল আজহা ও কোরবানির মাধ্যমে। কোরবানির শুরু বা প্রবর্তন কীভাবে, কখন থেকে এবং কোরবানির মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে মহান রাব্বুল আলামীন আল কুরআনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। আদি মানব হজরত আদমের (আ.) দু'পুত্র হাবিল ও কাবিলের কোরবানিই পৃথিবীর প্রথম কোরবানি । এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন

"আদমের দু'পুত্রের (হাবিল ও কাবিল) বৃত্তান্ত তুমি তাদের যথাযথভাবে শুনাও যখন তারা উভয়ে কোরবানি করল। তখন একজনের কোরবানি কবুল হলো এবং অন্যজনের কবুল হলো না, আল্লাহ মুত্তাকীদের কোরবানি কবুল করেন।" (সূরা মায়িদা, আয়াত-২৭)।

এখানে কোরবানি কবুল হওয়ার জন্য মুত্তাকী বা খোদাভীতিপূর্ণ পরিশুদ্ধ চিত্ততার কথা বলা হয়েছে। হাবিলের মধ্যে এটা ছিল তাই তাঁর কোরবানি আল্লাহর দরবারে কবুল হয়। কিন্তু কাবিলের মধ্যে এর অভাব ছিল, ফলে তার কোরবানি কবুল হয়নি। সে কারণে সে ক্ষিপ্ত হয়ে হাবিলকে হত্যা করল। খোদাভীতি না থাকলে তার কোরবানি তো কবুল হয়ই না, বরং সে একটির পর একটি অন্যায় কাজে প্রলুব্ধ ও ক্ষিপ্ত হয় এটা তারই প্রমাণ। তাই খোদাভীতি বা তাকওয়া শুধু কোরবানির কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত নয়, যে কোন ইবাদত কবুল হওয়া বা আদর্শ মুসলমান তথা প্রকৃত মানুষ হওয়ারও পূর্বশর্ত।

এ খোদাভীতি বা তাকওয়ার জীবন্ত প্রতীক ছিলেন আল্লাহর নবী-রাসূলগণ। যুগে যুগে তাঁদের অনুসরণ করে একদল লোক প্রকৃত মু'মিন বা আদর্শ মানুষে পরিণত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। কোরবানির ক্ষেত্রে তাকওয়ার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন মুসলিম মিল্লাতের পিতা হজরত ইবরাহীম (আ.) হজরত ইসমাঈল (আ.) এবং হজরত হাজেরা (আ.)। আমরা যে কোরবানি করে থাকি তা মুসলিম মিল্লাতের পিতা হজরত ইবরাহীমের (আ.) সুন্নত হিসেবে, আল্লাহর নির্দেশে তাঁর ও তৎপুত্র হজরত ইসমাঈলের (আ.) চরম আত্মোৎসর্গের ঐতিহাসিক স্মৃতিকে স্মরণ করে। স্বামী-স্ত্রী ও পুত্রের কোরবানি বা চরম আত্মোৎসর্গের স্মৃতিকে স্মরণ করে প্রতিবছর দশই জিলহজ তারিখে হাজীগণ মীনায় এবং দুনিয়ার সর্বত্র সমর্থ মুসলমানগণ জিলহজ মাসের দশ থেকে বার তারিখ পর্যন্ত কোরবানি করে থাকে। হজরত ইবরাহীম (আ.) আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তার প্রাণাধিক পুত্র হজরত ইসমাঈলকে (আ.) নিজ হাতে কোরবানি করার জন্য উদ্যত হয়ে মহান আত্মত্যাগের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। অবশ্য আল্লাহর অশেষ কুদরত ও মেহেরবানীতে হজরত ইসমাঈলের (আ.) পরিবর্তে কোরবানি হয়েছিল বেহেশত থেকে প্রেরিত একটি হৃষ্টপুষ্ট দুম্বা। হজরত ইবরাহীমের (আ.) আত্মত্যাগ বিশ্বের ইতিহাসে এক অনন্য ও অবিস্মরণীয় ঘটনা।

কোরবানির ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ

আল্লাহ পাক একদিন তার প্রিয় হাবীব হজরত ইবরাহীম খলিলুল্লাহকে (আ.) স্বপ্নযোগে তার প্রিয়তম বস্তুকে কোরবানি করার নির্দেশ দিলেন। সে হিসেবে তিনি পরের দিন বহু সংখ্যক বকরী কোরবানি করলেন। কিন্তু তারপর আবার নির্দেশ হলো_তোমার প্রিয়তম বস্তুকে কোরবানি কর। পরের দিন তিনি আরো অধিক সংখ্যক উট, দুম্বা ও মেষ কোরবানি করলেন। কিন্তু পরবর্তী দিন সেই একই নির্দেশ_কোরবানি কর তোমার প্রিয়তম বস্তুকে। তখন নবী ইবরাহীম (আ.) গভীরভাবে চিন্তা করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, বৃদ্ধ বয়সে পাওয়া তার প্রাণাধিক পুত্র ইসমাঈলের (আ.) চেয়ে প্রিয়তর কোনো কিছু তার পৃথিবীতে নেই। অতঃপর তিনি নিজ পুত্রকে আল্লাহর সন্তষ্টির উদ্দেশ্যে কোরবানি করার সিদ্ধান্ত নিয়ে কিশোর পুত্রকে ডেকে আল্লাহর নির্দেশের কথা বললেন। পিতার কথা শুনে মু'মিন পুত্র ইসমাঈলও (আ.) সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে নিজেকে আল্লাহর উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত হবার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়লেন।

এদিকে শয়তান এসে মা হাজেরাকে (আ.) পিতা-পুত্রের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিয়ে গেল, যাতে মাতৃ-মন বিক্ষুব্ধ হয়ে কোরবানি বন্ধ করার জন্য তিনি তৎপর হন। কিন্তু আল্লাহর নির্দেশের কথা শোনা মাত্র তিনিও ধৈর্যধারণ করলেন এবং নিজ পুত্রকে খাইয়ে-দাইয়ে সুন্দর পোশাকে সজ্জিত করে বাবার হাতে তুলে দিলেন। শয়তানের প্ররোচনায় তার মন এতটুকু বিচলিত হলো না। এটাই হচ্ছে প্রকৃত মু'মিন বা মুত্তাকীর লক্ষণ।

অতঃপর কোরবানির উদ্দেশ্যে মীনায় যাবার পথে শয়তান ইসমাঈলকে (আ.) প্ররোচনা দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তাতেও কোনো ফল হলো না। শয়তানের প্ররোচনায় কিশোর বালকের মন এতটুকু বিচলিত হলো না বরং শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করে তিনি নিজ সঙ্কল্পে অটল রইলেন। হজের সময় হাজীরা আজো সেখানে শয়তানকে উদ্দেশ্য করে কংকর নিক্ষেপ করে থাকেন। এটা শয়তানের ওয়াসওয়াসা থেকে নিজেকে রক্ষা করার এক প্রতীকী ব্যবস্থা। শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু। ভালো কাজে মানুষকে বিরত রাখা এবং মন্দ কাজে তাকে প্ররোচিত করা এটাই তার কাজ। তাই শয়তানের ওয়াসওয়াসা থেকে নিজেকে মুক্ত রেখে নিজেকে সর্বদা আল্লাহ ও রাসূলের (সা.) নির্দেশ মোতাবেক পরিচালনা করা মু'মিনের কর্তব্য। হজের সময় শয়তানের উদ্দেশ্যে কংকর নিক্ষেপ করে হাজীরা সেই শিক্ষাই লাভ করে থাকেন। ইনসানে কামিল হওয়ার জন্য এর গুরুত্ব অপরিসীম।

এরপর পিতা-পুত্র মীনা প্রান্তরে এসে উপনীত হলেন। পুত্রকে কোরবানির করার উদ্দেশ্যে পিতা তীক্ষ্ন ধার ছুরি হাতে নিয়ে প্রস্তুত হলেন। পুত্রশোকে তার চোখ দিয়ে অবিরত অশ্রু বিগলিত হতে লাগল। কিন্তু মন তার সুদৃঢ়-সবল। আল্লাহর নির্দেশ পালনে তার মনে এতটুকু কুণ্ঠা নেই। পুত্রের মনেও কোন দুঃখ নেই। মহান স্রষ্টার নির্দেশে তিনি নিজেকে উৎসর্গ করে দিচ্ছেন, এরচেয়ে মহত্তম কোনো কাজ আর হতে পারে না।

মানবজাতির ইতিহাসে পিতা-মাতা-পুত্রের চরম আত্মোৎসর্গের এরূপ দৃষ্টান্ত আর কখনো দেখা যায় না। তাই আল্লাহ মানবজাতিকে অনুপ্রাণিত করার উদ্দেশ্যে এ চরম ও অত্যুজ্জ্বল আত্মোৎসর্গের স্মৃতিকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছেন ঈদুল আজহা ও কোরবানি মাধ্যমে।

প্রাক-ইসলামী যুগে মানুষ কোরবানির করার পর কোরবানির পশুর গোশ্ত আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদন করার জন্য কা'বা ঘরের সামনে এনে রেখে দিত, পশুর রক্ত কা'বার দেয়ালে লেপ্টে দিত। সূরা হজের পূর্বোদ্ধৃত ৩৭ নং আয়াতে এ কুপ্রথার মূলেৎপাটন করে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে : কোরবানির পশুর রক্ত-মাংসের কোন প্রয়োজন আল্লাহর নেই; তিনি যা চান তা হলো কোরবানিরকারীর তাকওয়া, আল্লাহর প্রতি একান্ত আনুগত্য ও আল্লাহর প্রতি মু'মিন-চিত্তের একাগ্রতা। হজরত ইবরাহীম (আ.), হজরত ইসমাঈল (আ.) ও হজরত হাজেরার (আ.) মাধ্যমে আল্লাহ এরই পরীক্ষা নিয়েছিলেন। পশু কোরবানির মাধ্যমে যুগ যুগ ধরে মু'মিনদের এ পরীক্ষার ঐতিহাসিক ধারাই চলে আসছে। কোরবানিরকারী পশুর গলায় ছুরি চালিয়ে তার তাকওয়ার পরীক্ষা দেন। আর একথা সুবিদিত যে, স্বার্থপরতা ও কুপ্রবৃত্তির মধ্যে কখনো তাকওয়া বা খোদাভীতির সৃষ্টি হয় না। অতএব, কোরবানির আমাদের এসব মানবিক দুর্বলতার ঊর্ধে ওঠার শিক্ষা দেয়। আত্মশুদ্ধির জন্য যেমন এ ধরনের প্রশিক্ষণ অতীব গুরুত্বপূর্ণ, কল্যাণময়, সুন্দর মানবসমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যও তেমনি এটা অপরিহার্য। এদিক দিয়ে কোরবানির ব্যক্তিগত ও সামাজিক গুরুত্ব অপরিসীম।

 

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

অষ্ট্রেলিয়ান নও-মুসলিম সুসান ...
শিয়া-সূন্নীর মধ্যে পার্থক্য কি?
সূরা আত তাওবা;(৬ষ্ঠ পর্ব)
আহলে সুন্নতের দৃষ্টিতে ...
সূরা রা’দ; (১ম পর্ব)
ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রমের মর্যাদা ...
মিথ্যা কথা বলা
শিয়া মুসলমানরা কত ওয়াক্ত নামাজ ...
আল্লাহ্‌ কেন শয়তানকে সৃষ্টি ...
মুসলমানদের প্রথম কিবলা ...

 
user comment