বাঙ্গালী
Friday 29th of March 2024
0
نفر 0

বিশ্বে একই দিনে রোযা ও ঈদ উদযাপন

মীর রেজা হোসেইন শহীদ
॥ এক ॥প্রতিবছর পবিত্র রমজানুল মুবারক, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা আসলেই বাংলাদেশের কিছু কিছু এলাকার কতিপয় লোক সারাবিশ্বে একই দিনে সিয়াম, ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহা পালনের জন্য উঠে পড়ে লেগে যায়। এই বিষয়ক আলাপ-আলোচনার পর্যালোচনা আজ একটি জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে তাদের এ বিষয়টি নতুন ও মুখরোচক হওয়ার কারণে অনুসারীর সংখ্যাও ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনি একটি ইসলামের অ-মৌলিক ইস্যুতে বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে একটি জাতীয় বিভক্তি পরিগ্রহ করছে, যা কারোই কাম্য হতে পারে না। একে তো মুসলমানদের ঐক্যের বড়ই অভাব। এ ঐক্যের অভাবে ইসলামের শত্রুরা হায়েনার মতো চারিদিক থেকে আক্রমণ করছে এবং অনৈক্যের বীজ বপনের সুযোগেরও সন্ধান করছে।
পবিত্র রমজানুল মুবারকের সিয়াম ও ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা উদযাপনের জন্য মুসলমানগণ দিনক্ষণ হিসাব করেন। এ হিসাব নির্ধারণের জন্য চাঁদকে সময়ের মানদ- ধরবে নাকি সূর্যকে সময়ের মানদ- ধরবে এটি হচ্ছে মুখ্য বিষয়। যেহেতু বিষয়টি ইসলামের, তাই কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বরচিত কোন বিধান কারো উপর চাপিয়ে দেয়ার অধিকার আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কাউকে দেননি। আবহমানকাল থেকে মুসলমানগণ চাঁদ দেখে তাদের যাবতীয় ধর্মীয় কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। কিন্তু হঠাৎ করে কোন কারণে প্রশ্ন দেখা দিল যে, মুসলমানগণ চাঁদ দেখে দিনক্ষণ হিসাব করবে নাকি সূর্য দেখে ক্যালকুলেশন করে আগে থেকে নির্ধারিত সময়ে ঈদ করবে, না সৌদি আরবের সাথে মিলিয়ে ঈদ করবে? এ নিয়ে বিভিন্ন প্রকার জটিলতা বিরাজ করছে। আসুন এই জটিলতার জট খুলতে একটু পর্যালোচনা করি যে, আসলে সময় বা দিন তারিখ তথা সময় নির্ধারক কোনটি, চাঁদ নাকি সূর্য?
হযরত আদম থেকে অদ্যাবধি এ পৃথিবীতে আল্লাহর সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ বসবাস করছে। এতো বিশাল সময়ে কালের প্রবাহে মানুষ তাদের প্রয়োজনে সময়, দিন, তারিখ, জোয়ার-ভাটা-এর হিসাব করেছে, কখনো সূর্যের, কখনো চাঁদের হিসাব করেছে। এতে মানব সভ্যতার তেমন কোন সমস্যা হয়নি। কেন হয়নি? কারণ মানুষকে আল্লাহ গাইড করেছেন।
১৫ শতাধিক বছর পর্যন্ত মুসলমানগণ চাঁদের হিসাবে বার গুনেছে এবং সেই অনুযায়ী বিভিন্ন দ্বীনি কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। তাতে সূর্যের হিসাবে বার গণনা করেননি। মনে করুন আজকে শনিবার, আজ রাত আসার সাথে সাথেই মুসলিম মনীষীগণ একে রোববার বলেছেন। কিন্তু সূর্যের হিসাবে আমরা রাত ১২টা থেকে বার গণনা করে থাকি। সেজন্য চাঁদের বার এবং সূর্যের বার এক নয়। ধরুন, মরক্কোতে রাত আসার সাথে সাথে মাসের প্রথম চন্দ্র দেখা গেল। তার মানে সেই রাত থেকেই নতুন মাস গণনা করা শুরু হয়ে গেছে, ঠিক তেমনি ভারতেও যদি চাঁদ দেখা যায় তাহলে সেখানেও প্রথম দিন গণনা শুরু হয়ে গিয়েছে।
ধরুন সেই নতুন মাসটি রমজান, তাহলে ভারতের রাত হলো রমজান মাস, ঠিক তেমনি মরক্কোর মাস হলো রমজান মাস, কিন্তু সূর্যের হিসাবে তা একই দিন নয়। এমনকি এদের মধ্যে সূর্যের হিসাবে ০ দিন কিংবা ১ দিন কিংবা ২ দিনের মতো পার্থক্যও হতে পারে। কিন্তু চাঁদের হিসেবে কোন পার্থক্য নেই।
একটু ভেবে দেখুন! সেই সময়ের খলিফা সবাইকে ১ রমজানে ১০ টাকা করে বকশিশ দিবেন। তার মানে ভারতে যখন ১ রমজান আসবে তখন সেখান বকশিশ দেওয়া শুরু হবে। যখন মরক্কোতে আসবে তখন সেখানেও দেওয়া শুরু হবে। এখানে আইনস্টাইনের স্বীকার্যের মতো দুইটা কাঠামো। ১ম কাঠামো চাঁদ, ২য় কাঠামো সূর্য। প্রথম কাঠামোর দৃষ্টিতে যেটি ১ তারিখ, সেটি ২য় কাঠামোর দৃষ্টিতে একই তারিখ নাও হতে পারে। কোন সমস্যাই হবে না, যদি আমরা একটি কাঠামো অনুসরণ করি। একটু গভীরভাবে লক্ষ্য করুন; রাসূল আকরাম (সা.)-এর সময় ইসলামী সা¤্রাজ্যের আয়তন আর খলিফা চতুষ্টয়ের ইসলামী সা¤্রাজ্যের আয়তন কি এক ছিল? নিশ্চয়ই এক ছিল না। বিশেষ করে ২য় খলিফার যুগে মুসলিম সা¤্রাজ্য দ্রুত সম্প্রসারণ হয়েছে, তখন সারা ইসলামী সা¤্রাজ্যের মুসলিম অধিবাসীরা একই দিনে রোজা ও ঈদ উদযাপন করে ছিল কি? তৎপরবর্তী যুগের মুসলমান বিশেষজ্ঞদের মধ্যে এ বিষয়টি সমস্যা হিসেবে উদয় হয়েছে কি? উমাইয়া ও আব্বাসীয় শাসনামলের আলেমগণের মধ্যেও সারা বিশ্বে একই দিনে সিয়াম ও ঈদ উদযাপনের বিষয়টি সমস্যা হিসেবে উত্থাপিত হয়নি কেন? তাহলে তারা কি রাসূলের এতদ্্সংক্রান্ত হাদিস ও এর ব্যাখ্যা বুঝতে সমর্থ ছিলেন না? একথা সত্যি হয়ে থাকলে সমস্যা আরো জটিল; ঐ সময়কার আলেমগণের মধ্যে চার মাযহাবের চার ইমামও বিদ্যমান ছিলেন, কই তারা তো কখনো এ বিষয়টির ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত দিয়ে যাননি!
চাঁদের সময় গণনা সম্পর্কে ইসলামের দলিল
মহান আল্লাহ বলেন, ‘তারা তোমাকে নতুন চাঁদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। তুমি বলে দাও, তা মানুষের জন্য সময় নির্ধারক এবং হজের সময়েরও (তারিখ) নির্ধারক। (সূরা বাকারাহ-১৮৯) আয়াত দ্বারা সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, মানব জাতিকে চাঁদের হিসাবে তারিখ ও দিনক্ষণ হিসাব করতে হবে এবং হজের তারিখও নির্ণয় করতে হবে। সিয়াম ও ঈদ পালনের জন্য চাঁদ দেখা জরুরি, সূর্য দেখা জরুরি নয়। আল্লাহ চাঁদ দেখতে বলেছেন সূর্য দেখতে বলেননি। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা চাঁদ দেখে সিয়াম পালন কর এবং চাঁদ দেখে ঈদ উদযাপন কর। যদি চাঁদ অদৃশ্যমান থাকে তবে ৩০ দিন পূর্ণ কর। (সহিহ নাসাঈ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত হাদিস নং-২১২৮, সহিহ তিরমিযী, হুসাইন আল মাদানী প্রকাশনী, হাদি স নং-৬৮৮)।
আরও রয়েছে, ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত নাসাঈ হাদিস নং-১৭৮৫, বুখারি-আধুনিক প্রকাশনী, অনুবাদ-১৭৭৪, সহিহ মুসলিম-আহলে হাদিস লাইব্রেরী, হাদিস নং-১৮০৮, ১৮০৯, ১৮১০, ১৮১১, সহিহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত হাদিস নং-৬৮১, সহিহ ইবনে মাজাহ ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত হাদিস নং-১৬৫৫, আধুনিক প্রকাশনীর অনুবাদ হাদিস নং-১৬৫৫।
আব্দুর রহমান ইবনে যায়েদ (রা.) থেকে বর্ণিত, নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যদি তোমাদের দু'জন সাক্ষ্য দেয় যে, তারা (নতুন) চাঁদ দেখেছে, তাহলে তোমরা সিয়াম ও ঈদ পালন কর। (সহিহ নাসাঈ ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত হাদিস নং-২১২০)।
একই বক্তব্য সাহাবী আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা.) ও দিয়েছেন যখন উনাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, কতজন ব্যক্তির সাক্ষ্য প্রয়োজন। (সহিহ আবু দাউদ, হুসাইন আল মাদানী প্রকাশনী, হাদিস নং-২৩৩৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত হাদিস নং-২৩৩১)।আনাস ইবনু মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাহাবী আমার কতিপয় আনসার পিতৃব্য আমার নিকট বর্ণনা করেছেন যে, একবার শাওয়ালের নতুন চাঁদ (ঈদের চাঁদ) আমাদের নিকট অদৃশ্য থাকে। আমরা পরের দিন অর্থাৎ ঈদের দিন সিয়াম পালন করি। এমতাবস্থায়, ঐ দিনের (ঈদের দিনের) শেষভাগে একটি কাফেলা নবী (সা.)-এর কাছে এসে বিগতকাল চাঁদ দেখার সাক্ষ্য প্রদান করেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদের সিয়াম ভাঙতে নির্দেশ দিলেন। (আবু দাউদ, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অনুবাদ, হাদিস নং-১১৫৭, ২৩৩২, হুসাইন আল মাদানী প্রকাশনী, হাদিস নং-১১৫৭, ২৩৩৯, ইবনে মাজাহ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত ১৬৫৩, আধুনিক প্রকাশনী হাদিস নং-১৬৫৩)।
হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ঈদুল ফিতর হলো ঐ একদিন যেদিন সকল মানুষ ঈদুল ফিতর উদযাপন করে থাকে এবং ঈদুল আযহা হচ্ছে ঐ একদিন যেদিন সকল মানুষ ঈদুল আযহা পালন করে থাকে। (সহিহ তিরমিযী, হাদিস নং-৮০২, হুসাইন আল মাদানী কর্তৃক প্রকাশিত তিরমিযী, হাদিস নং-৮০২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত হাদিস নং-৮০০)। মা আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত হাদিসটি লক্ষ্য করুন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ঈদুল ফিতর হলো ঐ একদিন যেদিন সকল মানুষ ঈদুল ফিতর উদযাপন করে থাকে এবং ঈদুল আযহা হচ্ছে ঐ একদিন যেদিন সকল মানুষ ঈদুল আযহা পালন করে থাকে। (সহিহ তিরমিযী-হুসাইন আল মাদানী কর্তৃক প্রকাশিত হাদিস নং-৮০২, তিরমিযী-ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত হাদিস নং-৮০০)।
আবু হুরাইরাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, যেদিন তোমরা সিয়াম পালন কর সেদিন হলো সিয়াম। যেদিন তোমরা ঈদুল ফিতর পালন কর সেদিন হলো ঈদুল ফিতর আর যেদিন তোমরা ঈদুল আযহা পালন কর সেই দিন ঈদুল আযহা। (সহিহ তিরমিযী, হুসাইন আল মাদানী, হাদিস নং-৬৯৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত হাদিস নং-৬৯৫। সহিহ ইবনে মাজাহ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত হাদিস নং-১৬৬০, আধুনিক প্রকাশনী-এর অনুবাদকৃত হাদিস নং-১৬৬০)।
রাসূল (সা.) বলেন, তোমরা রোজা রাখবে না, যে পর্যন্ত না চাঁদ দেখতে পাও। একইভাবে তোমরা রোজা ভঙ্গ (ঈদ) করবে না, যে পর্যন্ত না শাওয়ালের চাঁদ দেখতে পাও। তবে যদি মেঘের কারণে তা তোমাদের কাছে গোপন থাকে, তবে শাবান মাস পূর্ণ করবে ত্রিশ দিনে। অপর বর্ণনায় আছে, তিনি (সা.) বলেন, মাস কখনও ঊনত্রিশ দিনেও হয়। (সূত্র : সহিহ বুখারি-৩য় খ-, ১৭৮৫-১৭৯০, সহিহ মুসলিম-৩য় খন্ড, ২৩৬৭-২৩৯৪)

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

বিভিন্ন ফিকাহর দৃষ্টিতে যাকাত
আল-কুরআনের মু’জিযা: একটি ...
সালাতে তারাবী না তাহাজ্জুদ ?
অর্থসহ মাহে রমজানের ৩০ রোজার দোয়া
ইসলাম ধর্ম, চিত্ত বিনোদন ও আনন্দ
জান্নাতুল বাকিতে ওয়াহাবি ...
কোরআনে কারিম তেলাওয়াতের আদব
মহানবীর ওফাত দিবস এবং ইমাম হাসান ...
পবিত্র কোরআনের আলোকে কিয়ামত
ইমাম হাসান (আ.)-এর জন্মদিন

 
user comment