বাঙ্গালী
Friday 29th of March 2024
0
نفر 0

আউলিয়াদের জীবন : আলহাজ মো. ওসমান আলী রহ

মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ : আলহাজ মো.ওসমান আলী (রহ.)। শুধু একটি নাম নয় বরং একটি ইতিহাস, একটি প্রতিষ্ঠান। একাধারে ভাষাসৈনিক, শিক্ষাবিদ, সরকারি কর্মকর্তা সর্বোপরি একজন দৃষ্টান্তমূলক মানুষ। সাধারণ শিক্ষার সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছেও তিনি ছিলেন বিস্ময়কর রকমের আল্লাহওয়ালা মানুষ। ছিলেন নির্লোভ। অপার্থিব চেতনাকে নিজের জন্য মুখ্য করে নিয়ে পার্থিবকে গৌণ করে নিয়েছেন নিজের জন্য।
উপনিবেশিক বাংলাদেশে একসময় মুখ থুবড়ে পড়েছিল মুসলিম শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতা। মুসলমানরা ভুলতে বসেছিল তাদের ইতিহাস ঐতিহ্যের কথা। তাদের এহেন পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ উপমহাদেশে পাঠিয়েছিলেন হযরত মোহাম্মদ মুস্তাফা (সা.)-এর আদর্শে উদ্ভাসিত কয়েকজন ওয়ালীকে। শাহ সূফী ওসমান আলী ছিলেন তাদের মধ্যেই একজন অগ্রসেনানী।
১৯২৭ সালের ২৯ এপ্রিল শুক্রবার নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা থানার ম-লের গাতী গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম তালুকদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ওসমান আলী (রহ.)। পিতা খুব মায়া করে ইসলামের দুজন খলিফা ওসমান এবং আলীর সমন্বয়ে নাম রাখলেন। পিতা মাহমুদ জান তালুকদার ও মা আয়েশা খাতুনের দ্বিতীয় সন্তান তিনি। ১৯৩৪ সালে ৭ বছর বয়সে তিনি নিজ গ্রামের মক্তবে ভর্তি হন। ১৯৩৪-৩৬ পর্যন্ত তিনি সেখানে পবিত্র কোরআন ও বাল্যশিক্ষা গ্রহণ করেন। ১৯৩৭ সালে পার্শ্ববর্তী বড়কাপন গ্রামে প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৪০ সালে অত্র স্কুল থেকে ৪র্থ শ্রেণীতে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৪১ সালে ভর্তি হন রানীগাঁও মিডিয়া ইংলিশ স্কুলে ৫ম শ্রেণীতে। সেখান থেকে ৫ম ও ৬ষ্ঠ শ্রেণী পড়াশোনা করে ১৯৪৩ সালে ৭ম শ্রেণীতে ভর্তি হন দুর্গাপুর থানার বিরিশিরি মিশন স্কুলে। এখান থেকে ৮ম শ্রেণী পাস করে ১৯৪৫ সালে ৯ম শ্রেণীতে ভর্তি হন বারহাট্টা থানার ভাউমী হাইস্কুলে। সেখানে ৯ম ও ১০ম শ্রেণী পড়াশোনা করেন। ১৯৪৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মেট্রিক (এসএসসি) পাস করেন। অতঃপর ভর্তি হন কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজে। ১৯৫১ সালে অত্র কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। বিএ অধ্যয়নকালে কিছুদিন তিনি কলমাকান্দা হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন। বিএ পাস করার পরপরই যোগদান করেন দুর্গাপুর থানার কালসিন্দুর হাইস্কুলে। সেখানে বছরখানেক শিক্ষকতা করেন। ঐ সময় পূর্বধলা থানার দুধী গ্রামের মরহুম জাহেদ আলী সাহেবের কন্যা মোসাম্মৎ জোবেদা বেগমের সাথে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৫১ সালের শেষে অথবা ১৯৫২ সালের শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে ভর্তি হন। ফজলুল হক হলের ২২২নং কক্ষে উঠেই অংশ নেন ভাষা আন্দোলনে। ১৯৫৫ সালে সেখান থেকে এমএ পাস করেন। অবশ্য পড়াশোনার পাশাপাশি প্রায় দেড় বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আপার ডিভিশন ক্লার্ক পদে চাকরিও করেন। এমএ পাস করার সাথে সাথেই তিনি ১৯৫৫ সালে সাব-রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ পান সিলেটের বিয়ানীবাজারে। ১৯৫৫ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন স্থানে সাবরেজিস্ট্রার পদে চাকরি করেন। ১৯৮১-৮৭ সাল পর্যন্ত জেলা রেজিস্ট্রার পদে চাকরি করে অবসর গ্রহণ করেন।
সূফী ওসমান আলী (রহ.) শিক্ষকতা, সাব-রেজিস্ট্রার, জেলা রেজিস্ট্রার পদে চাকরি করলেও তার জীবন ছিল সামগ্রিক মূল্যায়নে উজ্জ্বল-অত্যুজ্জ্বল। ৩২ বছর সাব-রেজিস্ট্রার ও জেলা-রেজিস্ট্রার হিসেবে চাকরি করলেও তিনি কোনোদিন এক পয়সা ঘুষ গ্রহণ করেননি। জীবনে নিষ্ঠা, সততা ও একাগ্রতার কারণে অফিসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সর্বনি¤œ পদস্থ কর্মচারী পর্যন্ত সবাই তাকে যথাযথ সম্মান, মূল্যায়ন ও শ্রদ্ধা করত। তার সততা ও সত্যবাদিতা এতটাই প্রখর ছিল যে, সহকর্মীরা সবসময়ই একধরনের সৎভয় করত তাকে।
সূফী ওসমান আলী (রহ.) ছিলেন দৃঢ় আবেদ একজন মানুষ। একাডেমিক আলেম না হলেও দীনের প্রয়োজনীয় সব বিধি বিধান তিনি জানতেন। ইসলামের প্রতিটি নীতি ও আমলকে সূক্ষèভাবে বিশ্লেষণ করে বাস্তব জীবনে যথাযথভাবে তা পালন করতেন। যদিও ১৯৬২ সালে ছারছীনা শরীফের মরহুম আবু জাফর মোহাম্মদ ছালেহ (রহ.)-এর হাতে বায়াত গ্রহণ করেন। তবে তিনি এর পূর্ব থেকেই একজন কামেল ওয়ালী ছিলেন। শৈশব-কৈশোর থেকেই ছিলেন ধর্মভীরু। সমগ্র জীবনে কোনো পাপ বা অন্যায় করেছেন, কারো অধিকার নষ্ট করেছেন, এমন প্রমাণ মেলেনি কোথাও। তিনি ছিলেন যথেষ্ট আল্লাহভীরু। এমনকি ছারছীনার পীর সাহেব তাকে দরবেশ বলে সম্বোধন করতেন। সর্বদা আজানের সাথে সাথে নামাজের জন্য মসজিদে চলে যেতেন। আজান হয়েছে অথচ তিনি দুনিয়ার কোনো কাজে লিপ্ত এমনটা কেউ কখনো দেখেনি। তিনি জীবনে স্বেচ্ছায় একটি মুস্তাহাব পর্যন্ত তরক করেননি। এশরাক, আউয়াবীন, চাশতের নামাজ পর্যন্ত তিনি কোনো দিন কাজা করেননি। সমগ্র জীবন ব্যয় করেছেন আল্লাহ ও রাসূলের পথে। সহায়তা করেছেন সমাজ উন্নয়নমূলক কাজে। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের জন্য তিনি ছিলেন আদর্শ ও কল্যাণের কা-ারী। ১৩টি মসজিদ ও ৫টি মাদরাসাসহ প্রায় দুই শতাধিক স্কুল-কলেজেও তিনি পৃষ্ঠপোষকতা, অনুদান দিয়েছেন, করেছেন সাহায্য। নেত্রকোণা, মোমেনশাহী, টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি মসজিদ ও মাদ্রাসা একক প্রচেষ্টায় গড়ে তুলেছেন। তাকে প্রত্যক্ষদর্শীরা অনেকেই এমন মন্তব্য করেছেন- ‘জীবিত এমন মানুষ আর দেখি নাই'।
ওসমান আলী (রহ.) একজন অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি ১১ সন্তানের জনক। আশ্চার্যের বিষয় যে, তার ছেলে-মেয়ে এবং জামাতারা একই সাথে দীনদার, পরহেজগার ও সামাজিক-আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। ১৯৮৮ সালে ছারছীনা দরবারের পীর মরহুম শাহ সূফী আবু জাফর সালেহ (রহ.)-এর সাথে এবং ২০০৫ ও ২০১১ সালে তিনি সস্ত্রিক হজব্রত পালন করেন। ২০০৩ সালে নেত্রকোনা সাংবাদিক কল্যাণ সংস্থা পুরস্কার, ২০০৯ সালে স্বাধীনতা সংসদ ভাষাসৈনিক পদক, ২০১০ সালে বিএসবি ক্যামব্রিয়ান শিক্ষানুরাগী পুরস্কারসহ আরো অনেক পুরস্কার ও স্বীকৃতি লাভ করেন। ইন্তেকালের পর তেরোটি জীবন দর্শন, ইসলামের মৌলিক দিক নির্দেশনামূলক পা-ুলিপি পাওয়া গেছে। ২০১৪ সালের ২০ জুন জুমাবার রাত ১টায় তিনি অসংখ্য শুভাকাক্সক্ষী ও সৎ সন্তানদের রেখে বর্ণাঢ্য জীবনের ইতি টানেন।

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

সিরিয়ায় দায়েশ অবস্থানে ...
কুরআন ও হাদীসের আলোকে হিংসা ও লোভ
সৌদি নেতারা হতভম্ব হবে: ...
ইরানের সিস্তান-বালুচিস্তান থেকে ...
অপহৃত স্কুলছাত্রীদের ফিরে ...
শিমারের বাধায় যুদ্ধ ঠেকানোর ...
শিকাগোতে গুলিতে নিহত ৭
অর্থ সঙ্কটে পড়তে যাচ্ছে ...
চট্টগ্রামে ইরান বিপ্লবের ৩৮তম ...
সংশয়, সমন্বয়হীনতা আর স্ববিরোধের ...

 
user comment