বাঙ্গালী
Friday 19th of April 2024
0
نفر 0

যালেম ফাসেকের নেতৃত্ব

ফাসেকের নেতৃত্ব সম্পর্কে তার মতামতের দুটি দিক রয়েছে। যা ভালভাবে উপলব্ধি করা । আবশ্যক। তিনি যে সময়ে এ ব্যাপারে মতামত প্রকাশ করেন, বিশেষ করে ইরাকে এবং সাধারণভাবে গোটা মুসলিম জাহানে তা ছিল দু'চরমপন্থী মতবাদের ভীষণ দ্বন্দ্ব-সংঘাতের যুগ। এক দিকে অত্যন্ত জোর দিয়ে বলা হচ্ছিল যে, যালেম ফাসেকের নেতৃত্ব একেবারেই না-যায়েয-সম্পূর্ণ অবৈধ। এ নেতৃত্বের অধীনে মুসলমানদের কোন সামাজিক কাজও নির্ভুল হতে পরে না। অপর দিকে আবার বলা হচ্ছিল যে, যালেম-ফাসেক যে কোনভাবেই রাষ্ট্রের ওপর জেকে বসুক না কেন, তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর নেতৃত্ব এবং খেলাফত সম্পূর্ণ বৈধ হয়ে যায়। এ দু'চরম মতবাদের মাঝামাঝি ইমাম আযম (র:) এক অতি ভারসাম্যপূর্ণ দর্শন উপস্থাপিত করেন। তাঁর এ দর্শনের বিস্তারিত বিবরণ এই :

আল-ফিকহুল আকবার-এ তিনি বলেন : ‘নেক-বদ যে কোন মুমিনের পেছনে সালাত জায়েয। [ মোল্লা আলী ক্বারী : ফিকহে আকবরের ভাষ্য, পৃষ্ঠা-৯১ ]

ইমাম তাহাভী আকীদা-ই-তাহাবীয়ায় এ হানাফী মতের ব্যাখ্যা করে লিখেন :

‘এবং হজ্জ ও জিহাদ মুসলিম উলিল আমর-এর অধীনে কেয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে-তা সে উলিল আমর নেক হোক, বা বদ-ভাল হোক, কি মন্দ। কেউ এ সব কাজ বাতিল করতে পারে না, পারে না তার সিলসিলা বন্ধ করতে। [ ইবনু আবিল ইয্ আল-হানাফী : শরহুত-তাহাবিয়্যাহ, পৃষ্ঠা-৩২২। ]

এটা আলোচ্য বিষয়ের একটি দিক। অপর দিক হচ্ছে এই যে, তাঁর মতে খেলাফতের জন্য আদালাত অপরিহার্য শর্ত। কোন যালেম-ফাসেক ব্যক্তি বৈধ খলীফা, কাযী, শাসক বা মুফতী হতে পারে না। এমন ব্যক্তি কার্যত অধিষ্ঠিত হওয়ার পর মুসলমানরা তার অধীনে তাদের সামাজিক জীবন যেসব কাজ শরীয়াতের সঠিক বিধান অনুযায়ী আঞ্জাম দেবে, তা জায়েয-বৈধ হবে, তার নিয়োগকৃত কাযী-বিচারক ন্যায়ত যেসব ফায়সালা করবে, তা জারী হবে-এটা স্বতন্ত্র কথা। হানাফী মাযহাবের প্রসিদ্ধ ইমাম আবুবকর আল-জাসসাস তাঁর ‘আহকামুল কুরআন ( কুরআনের বিধি-বিধান ) গ্রন্থে এ বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট করে ব্যক্ত করেছেন। তিনি লিখেন :

‘সুতরাং কোন যালেম-অত্যাচারী ব্যক্তির নবী বা নবীর খলীফা হওয়া জায়েয নয়। বৈধ নয় তার কাযী বা এমন কোন পদাধিকারী হওয়া, যার ভিত্তিতে দ্বীনের ব্যাপারে তার কথা গ্রহণ করা মানুষের জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে ; যেমন মুফতী, সাক্ষ্যদাতা বা নবী (স:)-এর তরফ থেকে হাদীস বর্ণনাকারী হওয়া ,,,,,,,,,[ ‘আমার অঙ্গীকার যালেমদের পৌছায় না'-(আল-বাকারা : ১২৪ ) ]-একথা প্রতিপন্ন করে যে, দ্বীনের ব্যাপারে যে লোকই নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব লাভ করে, তার সৎ এবং ন্যয়পরায়ণ হওয়া শর্ত।.........এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিতযে, ফাসেক-পাপচারীর নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব বাতেল। সে খলীফা হতে পারে না। আর কোন ফাসেক ব্যক্তি যদি নিজেকে এ পদে প্রতিষ্ঠিত করে বসে, তা হলে জনগণের ওপর তার আনুগত্য অনুসরণ বাধ্যতামূলক নয়। এ কথাই নবী (স:) বলেছেন যে, স্রষ্টার অবাধ্যতায় সৃষ্টির কোন আনুগত্য নেই। এ আয়াত এ কথাও প্রতিপন্ন করে যে, কোন ফাসেক ব্যক্তি বিচারপতি ( জজ-ম্যাজিষ্ট্রেট ) হতে পারে না। সে বিচারক হলেও তার রায় জারী হতে পারে না। এমনি করে, তার সাক্ষ্য গ্রাহ্য হতে পারে না, পারে না নবী (স:) থেকে তার বর্ণনা গ্রহণ করাযেতে। সে মুফতী হলে তার ফতোয়া মানা যেতে পারে না। [ আবুবকর আল জাসসাস : আহকামুল কুরআন, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৮০। ]

সামনে অগ্রসর হয়ে আল-জাসাস ষ্পষ্ট করে বলেন যে, এটাই ইমাম আবু হনীফা (র:)-এর মাযহাব। অত:পর তিনি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেন যে, ইমাম আবু হানীফা (র:)-এর ওপর এটা কত বড় যুলুম যে, তাঁর বিরুদ্ধে ফাসেকের ইমামত ও নেতৃত্ব বৈধ করার অভিযোগ উথ্থাপন করা হয় :

‘কেউ কেউ ধারনা করে নিয়েছে যে, ইমাম আবু হানীফা (র:)-এর মতে ফাসেকের ইমামত-খেলাফত বৈধ। .........ইচ্ছা করে মিথ্যা না বলা হলে এটা এক ভ্রান্ত ধারণা। সম্ভবত এর কারণ এই যে, তিনি বলতেন, কেবল তিনিই নন, ইরাকের ফকীহদের মধ্যে যাদের উক্তি প্রসিদ্ধ, তাঁরা সকলেই এ কথা বলতেন যে, কাযী-বিচারপতি স্বয়ং ; ন্যয়পরায়ণ হলে-কোন যালেম তাকে নিযুক্ত করলেও-তার ফায়সালা সঠিকভাবে জারী হয়ে যাবে। আর তাদের ফিসক সত্ত্বেও এ সব ইমামের পেছনে সালাত জায়েয হবে। এ মতটি যথাস্থানে সম্পূর্ণ ঠিক। কিন্তু এ দ্বারা এ কথা প্রমাণ করা যায় না যে, আবু হানীফা (র:) ফাসেকের ইমামত-কর্তৃত্বকে জায়েয-বৈধ জ্ঞান করতেন। [ আহকামুল কুরআন, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৮০-৮১। শামসুল আইম্যা সারাখসী ও আল-মাবসুত-এ ইমামের এ মত ব্যক্ত করেছেন। ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা-১৩০। ]

ইমাম যাহাবী এবং আল-মুয়াফফাক আল-মাক্কী উভয়েই ইমাম আবু হানীফা (র:)-এর এ উক্তিটি উদ্ধৃত করেছেন:

‘যে ইমাম ফাই অর্থাৎ জনগণের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ-ব্যবহার করে, অথবা নির্দেশে অন্যায়ের আশ্রয় নেয়, তার ইমামত-কর্তৃত্ব বাতেল; তার নির্দেশ বৈধ নয়। [ আয-যাহাবী : মানাকেবুল ইমাম আবি হানীফা ওয়া সাহেবাইহে, পৃষ্ঠা-১৭। আল -মাক্কী : মানাকেবুল ইমামিল আযম আবি হানীফা, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-১০০ ]

এ সব বিবৃতি গভীরভাবে অনুধাবন করলে এ কথা একেবারে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ইমাম আবু হানীফা (র:) খারেজী এবং মুতাষিলাদের সম্পূর্ণ বিপরীতে আইনত (Dejure) এবং কার্যত (defacto)-এর মধ্যে পার্থক্য করতেন। খারেজী এবং মুতাযিলাদের মতামত দ্বারা ন্যায়পরায়ণ এবং যোগ্য ইমামের অনুপস্থিতিতে মুসলিম সমাজ এবং মুসলিম রাষ্ট্রের গোটা ব্যবস্থাই অকেজো হয়ে পড়া অবধারিত ছিল। জজ-বিচারক থাকবে না, থাকবে না জুমা-জামায়াত, আদালত প্রতিষ্ঠিত হবে না, মুসলমানদের ধর্মীয়, সামাজিক-রাজনৈতিক-কো কাজই চলবে না বৈধভাবে। ইমাম আবু হানীফা (র:)-এ ভ্রান্তির অপনোদন করেছেন এভাবে যে, আইনানুগ ইমাম যদি সম্ভব না হয়, তবে যে ব্যক্তিই কার্যত মুসলমানদের ইমাম হবে, তার অধীনে মুসলমানদের গোটা সমাজ জীবনের পুরো ব্যবস্থাই বৈধভাবে চলতে থাকবে- সে ইমামের কর্তৃত্ব যথাস্থানে বৈধ না হলেও তা অব্যাহত থাকবে।

মুতাযিলা এবং খারেজীদের এ চরমপন্থার মুকাবিলায় মুর্জিয়া এবং স্বয়ং আহলুস সুন্নার কোন কোন ইমামও যে স্বতন্ত্র এক চরম পন্থা অবলম্বন করেছিলেন, ইমাম আবু হানীফা (রঃ) মুসলমানদেরকে তা এবং তার পরিণতি থেকে রক্ষা করেছেন। তারাও কার্যত আর আইনতঃ এর মধ্যে তালগোল পাকিয়ে ফেলে। ফাসেকের কার্যত কর্তৃত্বকে তারা এমনভাবে বৈধ প্রতিপন্ন করে যেন তাই আইনত-এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি এ হতো যে, মুসলমানরা অত্যাচারী-অনাচারী এবং দুরাচারী শাসনকর্তাদের শাসনে নিশ্চুপ-নিশ্চিন্ত বসে পড়তো। তাকে পরিবর্তনের চেষ্টা তো দূরের কথা, তার চিন্তাও ত্যাগ করতো। ইমাম আবু হানীফা (রঃ) এ ভ্রান্ত ধারণা আপনোদনের নিমিত্ত সর্বশক্তি নিয়োজিত করে এ সত্য ঘোষণা করেন যে, এমন লোকদের ইমামত কর্তৃত্ব সম্পূর্ণ বাতেল।

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

অর্থসহ মাহে রমজানের ৩০ রোজার দোয়া
কোরআন ও চিকিৎসা বিজ্ঞান
শিয়াদের মৌলিক বিশ্বাস (পর্ব-১)
সূরা ইউনুস;(১৭তম পর্ব)
মহানবী (স.) হতে বর্ণিত ৪০টি হাদীস (২)
পরকালের জন্য প্রস্তুতি এবং ...
মুবাহেলা
ইমাম মাহদী (আ.)এর আগমন একটি অকাট্য ...
গাদিরে খুম
হযরত ফাতেমার চরিত্র ও কর্ম-পদ্ধতি

 
user comment