বাঙ্গালী
Friday 29th of March 2024
0
نفر 0

ইসলামের দৃষ্টিতে কর্ম ও শ্রম (১ম পর্ব)

ইরানের বিখ্যাত কবি নেজামে গাঞ্জাবি লিখেছেনঃ
পৃথিবীর প্রতিটি ধূলিকণা, প্রতিটি অণু পরমাণু
ধূলি-ধূসর যদিও তা
রাষ্ট্রের বিচিত্র কাজে পরোক্ষে ব্যতিব্যস্ত সকলেই
নিজ নিজ কাজে সর্বদা
আমরা ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে সৃষ্টিজগতের বিচিত্র কর্মতৎপরতা এবং মানুষের কর্মময় জীবনের দায়িত্ব-কর্তব্য ও যৌক্তিকতা সম্পর্কে এখানে আলোচনা করবো।
আসলে সৃষ্টি জগতের প্রতিটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুই অত্যন্ত সুন্দর এবং সুশৃঙ্খলভাবে যে যার কাজে বা দায়িত্বে সর্বদা নিয়োজিত রয়েছে।এই সৃষ্টি জগত আল্লাহর ইচ্ছা ও শক্তির এক অনন্য প্রকাশ। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আকাশমণ্ডলী আর ভূপৃষ্ঠকে সৃষ্টি করেছেন ছয় দিনে এবং বাহ্যিক কোনো খুঁটি বা পিলার ছাড়াই নভোমণ্ডলীকে উর্ধ্বে স্থাপন করেছেন। ভূপৃষ্ঠকে সৃষ্টিরাজির জন্যে দোলনার মতো করে তৈরি করেছেন। আকাশ ছোঁয়া বিশাল বিশাল পাহাড়-পর্বতকে স্থাপন করে ভূপৃষ্ঠকে কম্পন থেকে সুরক্ষা করেছেন। এই ভূপৃষ্ঠকে আলোকিত করার জন্যে উজ্জ্বল জ্যোৎস্নাময় চাঁদ আর রঞ্জনরশ্মিময় সূর্যকে স্থান করেছেন। এই ভূপৃষ্ঠ বা পৃথিবী নামক গ্রহটিকে তার নিজস্ব কক্ষপথে পরিচালিত করেছেন যাতে রাত এবং দিনের সৃষ্টি হয়। একইভাবে বাতাসকে পাঠিয়েছেন যাতে মেঘকে এদিক ওদিক সঞ্চালিত করা যায় এবং উপযুক্ত অঞ্চলে খরা জর্জরিত তৃষিত ভূমির ওপর প্রাণসঞ্চারী বৃষ্টি বর্ষণ করে উদ্ভিদের চারা রোপনের ব্যবস্থা করা যায়।
আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন পানি এবং মাটি থেকে। তারপর তিনি মাটি দিয়ে সৃষ্ট ঐ বস্তুর ভেতর রূহের সঞ্চার করেছেন। আকাশ এবং যমিনকে মানুষের সেবায় সৃষ্টি করেছেন যাতে মানুষ তার কাজকর্ম এবং সৎ কর্মতৎপরতার মাধ্যমে ভূপৃষ্ঠের ওপর আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে অধিষ্ঠিত হতে পারে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী প্রতিনিয়ত কর্মতৎপর। সূরা আররাহমানের উনত্রিশ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ ‘নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের সবাই তাঁর কাছে প্রার্থী। তিনি সর্বদাই কোনো না কোন কাজে রত আছেন।' একইভাবে সৃষ্টিজগতের কোত্থাও বেকারত্ব কিংবা লক্ষ্য উদ্দেশ্যহীনতার কোনো স্থান নেই। প্রতিটি অণু পরমাণু থেকে শুরু করে গ্রহ নক্ষত্ররাজি সবাই যার যার নির্দিষ্ট পথে সুনিপুণ শৃঙ্খলার সাথে আপন আপন লক্ষ্যপানে সদা ধাবমান। বিরাম কিংবা একঘেঁয়েমির কোনো সুযোগ বা স্থান সৃষ্টিরাজ্যে নেই।
সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে তাই মানুষেরও উচিত সৃশৃঙ্খল এই ব্যবস্থাকে অনুসরণ করা। সৃষ্টি জগতের ছন্দ সুরের সাথে তাল মিলিয়ে এমন সমন্বিত জীবনের সুর তৈরি করা যাতে সৃষ্টিজগতের সকল বস্তুই সেই ছন্দ সুরে আপ্লুত হয়। এদিক থেকে চিন্তা করলে কাজ, চেষ্টা প্রচেষ্টা তথা কর্মতৎপরতা মানব জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হবে এবং বেকারত্ব ও বিশ্রামের মানে হলো সৃষ্টিজগত ও জীবনের প্রবাহ থেকে ছিটকে পড়া। এজন্যেই লক্ষ্য করা যায় মানবজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়ন এবং স্থায়ী পরিবতর্ন এখন অনস্বীকার্য একটি বাস্তবতা। উন্নত এবং জটিল এই মানব সমাজে তাই জীবনের সকল কোণেই বা সকল পর্যায়েই কাজের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। এমনকি বলা যেতে পারে কাজ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে আত্মা এবং মনের ওপর, চিন্তাপদ্ধতির ওপর, মানুষের মূল্যবোধের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে।
চলমান জীবন প্রবাহের গতিশীলতার জন্যে বা জীবন ধারণের জন্যে মানব সমাজকে অবশ্যই কাজ বা চেষ্টা প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। মানুষের বড়ো বড়ো আশা আকাঙ্ক্ষা বা বৃহৎ মূল্যবোধগুলো অর্জন করার জন্যে নিরন্তর উদ্যম ও প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবার কোনো বিকল্প নেই। যেকোনো দেশ বা জাতি উন্নতির শিখরে আরোহন করতে চাইলে অবশ্যই সেই জাতিকে কর্মতৎপর হতে হবে, অলসতা পরিহার করে চলতে হবে। যুগে যুগে যারাই বড়ো বড়ো সভ্যতার জন্ম দিয়েছেন তারা নিরলস পরিশ্রমী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁরা নিজেদের খোদাপ্রদত্ত মেধাকে কাজে লাগিয়ে সৃষ্টি জগতে অনন্য অবদান রেখে গেছেন। বিশাল বিশাল অট্টালিকা নির্মাণ যেমন ইরানের ঐতিহাসিক পার্সেপোলিস প্রাসাদ, মিশরের বিশাল বিশাল পিরামিড কিংবা অধুনালুপ্ত চীনের প্রাচীর ইত্যাদি মানুষের এই সৃষ্টিশীল চিন্তারই ফল। আধুনিক কালের গগণচুম্বি অট্টালিকা বা টাওয়ার নির্মাণ, মহাশূণ্য জয় কিংবা আকাশে মানুষের উড্ডয়ন, দূরারোগ্য রোগের চিকিৎসা, মহাসড়ক, টানেল, বিশাল বিশাল শিল্প কারখানা নির্মাণ, যোগাযোগের জন্যে বিস্ময়কর ডিজিটাল সিস্টেম প্রভৃতি মানুষেরই সৃজনশীল চিন্তা আর নিরলস কর্মপ্রচেষ্টার উপহার। এগুলোকে তাই সুন্দর অর্থাৎ ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা উচিত।
কর্ম প্রচেষ্টার কল্যাণে মানুষের জীবন নামক বৃক্ষটি ফলে ফুলে সুশোভিত হতে পেরেছে, মানুষের অন্তরাত্মা ও দেহ থেকে দুর্বলতা আর বিরক্তি বিদূরিত হয়। মানব জীবন থেকে যদি কর্ম তৎপরতা লোপ পায়, তাহলে তার পতনের ধারার সূচনা হবে। ‘সভ্যতার ইতিহাস' নামক গ্রন্থের লেখক বিল ডুরান্ট লিখেছেন ‘সুস্থতা কাজের মাঝে নিহিত। মানব জীবনের সুখ সমৃদ্ধি আর সন্তুষ্টির মূল রহস্যগুলোর একটি হলো পেশা বা কাজ। আমার দৃষ্টিতে আল্লাহর কাছে ধন সম্পদ না চেয়ে কাজ এবং আমলের তৌফিক চাওয়াটাই উত্তম।' মানুষের জন্যে পানাহার যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি কাজও অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু কেন? মানুষ কি তার বস্তুগত প্রয়োজনে কিংবা উত্তম জীবনযাপনের জন্যে কাজ করবে? মানুষ কি কেবল খাবার দাবারের সংস্থানের জন্যেই কাজ করবে? এ প্রশ্নের জবাবে বিভিন্ন মতবাদে বিভিন্ন রকম দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। কেউ কেউ কর্মপ্রচেষ্টাকে কেবল দুনিয়াবি স্বার্থ সিদ্ধি বা মানুষের বস্তুতান্ত্রিক জীবনের প্রয়োজনীয়তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ করেছেন,যদিও আরো অনেক মতবাদ ও চিন্তাধারায় ভিন্নরকম দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা হয়েছে।
ইসলাম কাজকে একটু বিস্তৃত পরিসরে চিন্তা করে। মানুষের সাথে সৃষ্টিজগতের অন্যান্য সম্পর্কের মতোই কাজও পার্থিব এবং আধ্যাত্মিক উভয় দিক থেকেই প্রয়োজনীয় বলে ইসলাম মনে করে। আমরা পরবর্তী আসরগুলোতে ইসলামী চিন্তাদর্শ ও সংস্কৃতিতে কাজের অবস্থান ও গুরুত্ব সম্পর্কে কথা বলার চেষ্টা করবো। কাজের সংজ্ঞা, ইসলামে এর সাংস্কৃতিক ও দার্শনিক ব্যাখ্যা কীরকম, সেগুলো নিয়েও আলোচনা করা ইচ্ছে রইলো। নবী করিম (সা) এবং তাঁর আহলে বাইতের জীবন চরিতে কাজ কীরকম গুরুত্ব পেয়েছে সেদিকেও নজর দেওয়ার চেষ্টা করবো। মানুষের অন্তরাত্মার ওপর কাজের ইতিবাচক প্রভাব, কাজের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক গুরুত্ব, ইসলামে কাজের শিষ্টাচার ও চরিত্র ইত্যাদি বিষয়েও আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ।
কাজের সামর্থ থেকে মানুষ যদি উপকৃত না হতো কিংবা সবচেয়ে কম কাজ করেই যদি মানুষ সকল নিয়ামতের অধিকারী হয়ে যেত, তাহলে তাদের জীবন হয়ে যেত আনন্দ উল্লাসহীন। জীবনের অর্থ বা মজাই হারিয়ে যেত। এ সম্পর্কে ইমাম সাদেক (আ) এর বক্তব্যের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু করবো আজকের আলোচনা।
নবীজীর আহলে বাইতের মহান উত্তরপুরুষ ইমাম জাফর সাদেক (আ) মানুষের আত্মার ওপরে কাজের ইতিবাচক প্রভাব এবং কাজের মানসিক স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে বলেছেনঃ ‘মানুষের সকল প্রয়োজনীয়তা যদি কোনোরকম কাজকর্ম ছাড়াই পূরণ হয়ে যেত তাহলে কক্ষণো তাদের জীবন স্বাস্থ্যকর হতো না এবং জীবন উপভোগ্য হয়ে উঠতো না। ধরা যাক কোনো এক লোক এমন একদল মেহমানের সাথে যোগ দিলো যাদের খাওয়া পরার সকল দায় দায়িত্বসহ সব ধরনের সেবারই নিশ্চয়তা রয়েছে। একটা সময় পর বেকার বসে খাবার দাবার করতে করতে ঐ লোকটা ক্লান্ত হয়ে যায় এবং অবশেষে কাজের সন্ধানে যায় যাতে তার বেকারত্বের অবসান হয়। এখন ভাবুন যদি সারাটি জীবন মানুষের সকল প্রয়োজনীয়তা, সকল চাহিদা আপনা আপনি মিটে যেত তাহলে মানুষের অনুভূতিটা কীরকম হতো।' তাঁর এ বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে কাজ কেবল মাত্র আয়রোজগারের জন্যেই নয় বরং সুস্থ থাকা এবং ব্যক্তিত্ববান হবারও গোপন রহস্য। অগাধ অর্থ সম্পদের মালিক হবার পরও তাই কাজের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
বিখ্যাত ফরাশি লেখক ও কবি ফ্রাঁসোয়া ভলতেয়ার বলেছেন, ‘যখনি অনুভব করি কষ্ট, ক্লান্তি আর রোগব্যাধি আমাকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে তখন কাজের আশ্রয় নিই, কেননা আমার ভেতরের যন্ত্রণার সবচেয়ে উত্তম প্রতিষেধক হচ্ছে কাজ। সেজন্যেই কাজের অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক উভয়বিধ ফায়দা বা উপকারিতা রয়েছে। তাছাড়া মানুষের ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবন কাজ এবং দায়িত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত। মানুষের সফলতার রহস্য এই কর্মতৎপরতার পরিমাণের ওপর নির্ভরশীল। যিনি ব্যক্তিগত ও সামাজিক দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে যতো বেশি কর্মতৎপর হবেন, তিনি ততো বেশি সফল হবেন এটাই স্বাভাবিক। সাধারণত যে কোনো কাজেরই একটা নির্দিষ্ট চিন্তাদর্শ ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি থাকে। যারা কাজকে কেবলমাত্র বস্তুগত লক্ষ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে রাখতে চায় তারা ইহজাগতিক চাহিদা মেটানোকেই কাজের একমাত্র উদ্দেশ্য বলে মনে করে। কিন্তু যারা তাকে বস্তুজাগতিক চাহিদার অনেক উর্ধ্বে বলে মনে করে তারা কাজকে একটা সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখে এবং কাজকে তারা অনেক বড়ো উদ্দেশ্য তথা মানবীয় পূর্ণতা অর্জনের উপায় হিসেবে বিবেচনা করে।
ইসলামে মানুষের অস্তিত্বটা দ্বিমাত্রিক। একটি হলো আধ্যাত্মিক এবং অপরটি বস্তুতান্ত্রিক। আল্লাহ পাক মানুষের সৃষ্টির সেরা হিসেবে মর্যাদাবান করেছেন এবং আকাশ ও যমিনের সকল বস্তুকেই মানুষের সেবায় নিয়োজিত করেছেন। পবিত্র কোরআনের সূরা লোকমানের ২০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ ‘তোমরা কি দেখ না আল্লাহ নভোমন্ডল ও ভূ-মন্ডলে যাকিছু আছে,সবই তোমাদের কাজে নিয়োজিত করে দিয়েছেন এবং তোমাদের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নেয়ামতসমূহ পরিপূর্ন করে দিয়েছেন'? এ থেকে বোঝা যায় মানুষকে শ্রেষ্ঠ করে সৃষ্টি করার পেছনে আল্লাহর কোনো একটা উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই রয়েছে। যেমনটি বলা হয়েছে সূরায়ে জারিয়াতের ৫৬ নম্বর আয়াতেঃ ‘আমার এবাদত করা ছাড়া আর কোনো কাজের জন্যে আমি মানব ও জিন জাতিকে সৃষ্টি করি নি।' ফলে মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্যটা পরিস্কার, তাহলো আল্লাহর ইবাদাত করা। এজন্যে মুমিন যে, তার কোনো একটি কাজও সেই উন্নত ও বৃহৎ লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত থাকতে পারে না। তার প্রতিটি কাজেরই লক্ষ্য হবে ইবাদাত তথা আল্লাহর আনুগত্য। আর এই ইবাদাতের পথ ধরে আত্মিক এবং আধ্যাত্মিক পূর্ণতায় পৌঁছানোটাই মূল লক্ষ্য।
আল্লাহ মানুষকে যেসব নিয়ামতের অধিকারী করেছেন ধন সম্পদ সেগুলোর একটি। সেজন্যে কোনো মুসলমানের ধন সম্পদ কেবল তার একারই নয় বরং তার মধ্যে অন্যদেরও অধিকার রয়েছে। যাকাত বা খুমুস প্রদান সেই অধিকারেরই অংশ। এটা কোনো দান নয় কিংবা খয়রাতও নয় এটা বাধ্যতামূলক প্রদেয়। ফলে যাকাত খুমুস প্রদান আল্লাহর ইবাদাতের শামিল। যাকাত খুমুস প্রদান আল্লাহর কাছে গৃহীত হবার জন্যে শর্ত হলো আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে আন্তরিকতার সাথে প্রদান করা। এজন্যে সম্পদ অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করাটাও আধ্যাত্মিকতার প্রবাহে মিলিত হবার শামিল বলে এটা ইবাদাত হিসেবে গণ্য। কোনো ব্যক্তি যদি নিজের এবং পরিবারের চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে কিংবা জনকল্যাণের লক্ষ্যে কাজ করে তাহলে তা ইবাদাত। অবশ্য তা হতে হবে আল্লাহর আদেশ নিষেধের মানদণ্ডের ভিত্তিতে। আর সেই অনুযায়ী যদি কর্মকাণ্ড চলে তাহলে পরকালেও তার পুরস্কার রয়েছে। এজন্যেই রাসূলে খোদা (সা) বলেছেন ‘দুনিয়া হচ্ছে আখেরাতের কৃষিক্ষেত্র'। পার্থিব জগতের সকল সুযোগ সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে তাঁরই প্রদর্শিত পথে চলা যায়, তাঁরই নির্দেশনা অনুযায়ী কর্মতৎপরতা চালানো যায় তাহলে পার্থিব স্বার্থ হাসিলের পাশাপাশি পরকালীন স্বার্থও অর্জিত হয়।
ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গিটা হলো একজন মুসলমান যেহেতু নিজে আল্লাহর অফুরন্ত নিয়ামতের অধিকারী হয় সেহেতু অন্যান্যদেরকেও আল্লাহর সেই নিয়ামতের অধিকারী হতে সহযোগিতা করা তার কর্তব্য। আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহ থেকে একজন মুসলমান যথার্থ পন্থায় উপকৃত হয় এবং সেই অনুগ্রহের ব্যাপারে অকৃতজ্ঞতা পোষণ করে না।ইসলামের অর্থণৈতিক ব্যবস্থায় বস্তুগত ধন সম্পদ হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে দেওয়া আমানত। নিজের এবং সমাজের আত্মিক উৎকর্ষ সাধনের জন্যে এইসব নিয়ামতকে কাজে লাগানো উচিত। এইদিক থেকে বিবেচনা করলে একজন মুসলমান বিশ্বকে গড়া এবং সংস্কার করার জন্যে একজন দায়িত্বশীল হিসেবে নিজেকে মনে করে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সূরা হুদের একষট্টি নম্বর আয়াতে বলেছেনঃ ‘তিনিই যমিন হতে তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে আবাদ করার জন্যে তোমাদের ওপর দায়িত্ব দিয়েছেন'। এই দায়িত্ব পালনের জন্যে যেই তৎপরতা, তাই কাজ। মানুষ তার মেধা ও মনন দিয়ে কাজ করার ফলেই নতুন নতুন প্রযুক্তি ও বিভিন্ন জিনিস আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে।
কাজের গুরুত্ব এবং এ সম্পর্কে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমরা কথা বলছিলাম। বিশেষ করে ইসলামের দৃষ্টিতে কাজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য এবং এ সংক্রান্ত দর্শন নিয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করছিলাম। আজকের আসরে আমরা এ সংক্রান্ত আরেকটি দিক নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করবো।
ইসলামসহ বিশ্বের প্রতিটি অর্থব্যবস্থারই নিজস্ব দর্শন এবং বিশ্বদৃষ্টি রয়েছে। যেমনটি গত আসরে বলেছিলাম ইসলামী চিন্তাদর্শনে মানুষের জীবনের ওপর তার বোধ ও বিশ্বাসের কেন্দ্রিয় ভূমিকা রয়েছে। সেজন্যে একজন মুসলমানের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে তার বিশ্বাসের সম্পর্ক খুবই নিবীড়।অন্যভাবে বলা যেতে পারে ইসলামে একজন মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডসহ জীবনের প্রত্যেকটি বিষয় ধর্মীয় বিশ্বাস ও শিক্ষার কাঠামো অনুযায়ী সম্পাদিত হয়। ইসলামী চিন্তাদর্শ অনুযায়ী একজন মানুষের জীবন বা অস্তিত্বের দুটি দিক রয়েছে। একটি তার বস্তুগত জীবন অপরটি তার আধ্যাত্মিক জীবন। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সৃষ্টিকূলের সেরা জীব হিসেবে সৃষ্টি করেছেন এবং অপরাপর সকল সৃষ্টির ওপর মানুষকে মর্যাদাবান করেছেন। তাই মানুষের কর্তব্য হলো তার অভ্যন্তরীণ মেধা ও সৃজনশীলতা এবং তার বোধ ও বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে মানবীয় তথা তার আত্মিক ও আধ্যাত্মিক পূর্ণতায় পৌঁছার জন্যে চেষ্টা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।
এই লক্ষ্য বাস্তবায়ন করার জন্যে আল্লাহ তায়ালা মানুষের জন্যে প্রয়োজনীয় সকল সুযোগ সুবিধা সকল পন্থা ও উপায় উপকরণ দিয়ে দিয়েছেন,যাতে মানুষ তার বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক চাহিদাগুলো সহজেই মেটাতে পারে। মানুষ তার প্রয়োজন মেটানোর জন্যে কাজ করতে বাধ্য। এদিক থেকে বিচার করলে দেখা যাবে ইসলামের দৃষ্টিতে এ বিষয়টির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। কর্মতৎপরতা ইহকাল এবং পরকালীন জগতে মানুষের ভাগ্য নির্ধারণী একটি উপায়। কোরআনে কারিম আশিটিরও বেশি আয়াতে মানুষের সৌভাগ্যের শর্ত হিসেবে দুটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করেছে। একটি হলো ইমান এবং অপরটি সৎ কাজ। সাংসারিক বা পারিবারিক ব্যয় নির্বাহ করার জন্যে সময় দেওয়া এবং পরিশ্রম করাটা সৎ কাজের অন্তর্ভুক্ত। অবশ্য ইসলামে সৎ লক্ষ্য উদ্দেশ্যে পৌঁছার জন্যে যে কাজই করা হোক না কেন সেই কাজ অত্যন্ত মূল্যবান হিসেবে পরিগণিত।
যেই প্রকৌশলী বিশাল কোনো ভবনের নকশা তৈরির জন্যে কাগজের ওপর রেখাচিত্র আঁকেন, যেই আর্টিস্ট তাঁর সময় এবং মেধাকে কাজে লাগিয়ে ক্যানভাসে প্রকৃতির বিচিত্র ছবি আঁকেন, যেই শিক্ষক স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের পড়ান কিংবা যেই মালি বাগানের কাজ করেন বা যেই কৃষক কৃষিকাজে ব্যস্ত সময় কাটান, তাঁরা সকলেই সামাজিক উন্নয়ন ও বিকাশের ক্ষেত্রে অবদান রেখে যাচ্ছেন। সামগ্রিকভাবে ধর্মীয় দৃষ্টিতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারেঃ ‘ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং বিধি বিধানের আলোকে জনকল্যাণ ও সামাজিক মর্যাদাকে রেো উন্নত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সেবামূলক কাজকর্ম কিংবা পণ্য উৎপাদন করার জন্যে যেসব তৎপরতা চালানো হয়, সেইসব তৎপরতাকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেবে গণ্য করা হয়।'
আয় উপার্জনের মৌলিক পন্থাই হলো কর্ম তৎপরতা। পবিত্র কোরআনের বহু আয়াতে মানুষের জীবিকার প্রয়োজন মেটানোর জন্যে আল্লাহর দেওয়া বিচিত্র রহমত ও অনুগ্রহের খোজেঁ মানুষকে যমিনে চাষাবাদ করার ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। কেবল অনুপ্রাণিতই নয় বরং বহুভাবে তার গুরুত্বও তুলে ধরা হয়েছে। বহু আয়াতে আসমান এবং যমিনকে মানুষের বশীভূত করার কথা, দিবারাত্রি সৃষ্টির কথা, বাতাস এবং বৃষ্টিকে পাঠানোর কথা, নৌকা চালানোর কথা ইত্যাদির উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহর রহমত ও কল্যাণ কামনা এবং রুটিরুজির অনুসন্ধান প্রসঙ্গেই এসবের উল্লেখ করা হয়েছে। আর আল্লাহও তাঁর প্রাকৃতিক নিয়ামতগুলোকে খুজেঁ বের করার দায়িত্ব মানুষের ওপরই অর্পন করেছেন। মানুষের একান্ত নিজস্ব দায়িত্ব হলো দিবারাত্রি পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে তাদের জ্ঞান বুদ্ধি বিবেককে কাজে লাগিয়ে নিজেদের বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক কল্যাণ ও উন্নতি বিধান করা। কোরআনে পাকে আমরা লক্ষ্য করবো সূরা হুদের ৬১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ মানুষকে যমিনে চাষাবাদ করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানুষের জন্যে সর্বপ্রকার সুযোগ সুবিধাকে প্রস্তুত করে রেখেছেন, এখন মানুষের কাজ হলো সেগুলোকে খুঁজে বের করা এবং সেগুলোর সাহায্যে নিজেদের সার্বিক অভাব ও দৈন্যতা দূর করা।
কোরআনের অসংখ্য আয়াতে মানুষের জন্যে দেওয়া আল্লাহর বিচিত্র নিয়ামতের কথা বলা হয়েছে। সূরায়ে লোকমানের বিশ নম্বর আয়াতে এই নিয়ামতের কথা বলা হয়েছে এভাবেঃ তোমরা কি দেখ না আল্লাহ নভোমন্ডল ও ভূ-মন্ডলে যা কিছু আছে,সবই তোমাদের কাজে নিয়োজিত করে দিয়েছেন এবং তোমাদের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নেয়ামতসমূহ পরিপূর্ন করে দিয়েছেন? আল্লাহ রাব্বুল অপর একটি আয়াতে বলেছেনঃ ‘আকাশ, যমিন, সমুদ্রগুলো, পাহাড় পর্বতরাজি, নদীসমূহ এবং সর্বপ্রকার প্রাণীকে মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন যাতে তা থেকে তাঁর বান্দারা উপকৃত হতে পারে।' একইভাবে সূরায়ে কাসাসের সাতাত্তর নম্বর আয়াতে আল্লাহর দেওয়া সেইসব নিয়ামতকে আখেরাত তথা পরকালীন জীবনের পাথেয় সঞ্চয়ের কাজে ব্যবহার করার আহ্বান জানানো হয়েছে। বলা হয়েছেঃ আল্লাহ তোমাকে যা দান করেছেন,তা দিয়ে পরকালের গৃহ অনুসন্ধান কর,এবং ইহকাল থেকে তোমার লাভবান হবার কথা ভুলে যেয়ো না। তুমি অনুগ্রহ কর,যেমন আল্লাহ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন।' প্রকৃতপক্ষে প্রকৃতিকে জয় করে আল্লাহর দেওয়া নিয়ামতগুলো অর্জন করতে হলে শ্রম বা কাজের কোনো বিকল্প নেই। অলসতা বা কর্মহীন জীবন যাপনের মধ্য দিয়ে সেসব অর্জন করার কোনো সুযোগ নেই।
এখানে প্রকৃতিকে জয় করার মানে হলো ব্যবসা-বাণিজ্য , পশুপালন, কৃষিকাজ, খনিজ সম্পদ উত্তোলনসহ বিচিত্র পণ্য উৎপাদনের মতো কাজ করার মধ্য দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা। আর এসব কাজ করতে গেলে মেধা খাটাতে হয়, পরিশ্রম করতে হয়। এই পরিশ্রমই উন্নতি ও সৌভাগ্যের মূল চাবিকাঠি। আল্লাহ পাক মানুষের আয় রোজগারের জন্যে যেসব ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রেখেছেন, সেগুলোকে রহমত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সূরা কাসাসের তিয়াত্তর নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ ‘তিনিই স্বীয় রহমতে তোমাদের জন্যে রাত ও দিন করেছেন,যাতে তোমরা তাতে বিশ্রাম গ্রহণ কর ও তাঁর অনুগ্রহ অন্বেষণ কর এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।' আল্লাহ পাক কাজ করার ওপর এতো গুরুত্ব দেওয়া সত্ত্বেও অনেকে মনে করেন জীবন-জীবিকার জন্যে এতো কাজ করা দুনিয়া পূজার শামিল। তাদের বক্তব্য হচ্ছে রুটি রুজির বিষয়টি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত হয়েই আছে ফলে কাজের মাঝে তার কোনো লাভ-ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। অথচ সকল নবী রাসূলই পৃথিবীতে এসে ব্যাপক পরিশ্রম করেছেন এবং অন্যান্যদেরকেও সৎ পথে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। আল্লাহ আমাদের সৎ পথে থেকে কাজ কর্ম করার তৌফিক দিন।(রেডিও তেহরান)

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

হযরত আলী (আ.)-এর খেলাফত ও তার ...
ইমাম হাসান (আ.) এর শাহাদাত
হাদীসে গাদীর এবং আলী (আ.)-এর খেলাফত
হযরত ইমাম হাদি (আ.) ছিলেন একজন ...
দুই নামাজ একসাথে পড়ার শরয়ী দললি
পবিত্র কুরআন ও সুন্নাতের আলোকে ...
কুরআন ও ইমামত সম্পর্কে ইমাম জাফর ...
ইমাম হুসাইন (আ.)এর ঘাতকদের খোদায়ি ...
শহীদদের নেতা ইমাম হুসাইন (আ.)'র ...
হযরত ফাতেমার প্রতি নবী (সা.)-এর ...

 
user comment