বাঙ্গালী
Friday 29th of March 2024
0
نفر 0

মানুষের ঐশী প্রতিনিধিত্ব-শেষ অংশ

ঐশী প্রতিনিধিত্বের সীমা

খলিফা বা প্রতিনিধি হল সেই ব্যক্তি যে প্রতিনিধি নিয়োগকারীর স্থলাভিষিক্ত হয়। কখনও প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি সময়গত। অর্থাৎ সময়ের দৃষ্টিতে প্রতিনিধিত্ব লাভকারীব্যক্তি প্রতিনিধি নিয়োগকারীর পরে আসে এবং কখনও প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি পর্যায় বা মর্যাদাগত। প্রথম ক্ষেত্রে মর্যাদার দিক থেকে প্রতিনিধি নিয়োগকারী প্রতিনিধির ওপর শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হওয়া অপরিহার্য নয়। খলিফা বা প্রতিনিধি যার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে তার থেকে শ্রেষ্ঠ হতে পারে,আবার নিম্নতরও হতে পারে। এক্ষেত্রে বিষয়টি রহিত ও রহিতকারী বিধানের ন্যায়,যে ক্ষেত্রে রহিতকারী বিধান রহিত বিধান অপেক্ষা শক্তিশালী। কিন্তু কখনও প্রতিনিধিত্বের এ বিষয়টি অস্তিত্বের ক্রম ও মর্যাদার দৃষ্টিতেবিবেচিত হয়। এ দৃষ্টিতে প্রতিনিধি নিয়োগকারী অবশ্যই প্রতিনিধি থেকে শ্রেষ্ঠ এবংপ্রতিনিধি তার শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়টি নিয়োগদাতার মনোনয়নের কারণে লাভ করে। তার বৈধতা,ক্ষমতা ও শ্রেষ্ঠত্ব নিয়োগদাতার অনুগ্রহ ও সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল এবং তার অনুগ্রহ ব্যতীত প্রতিনিধির কোন ক্ষমতা ও বৈধতা নেই। সুতরাং প্রতিনিধি অস্তিত্বগতভাবে মর্যাদায় তার নিয়োগকারী হতে নিম্ন পর্যায়ে। এরূপ ক্ষেত্রে প্রতিনিধি কখনও নিজেকে শ্রেষ্ঠ বা নিয়োগকারীর সমপর্যায়ে গণ্য করতে পারে না। এরূপ করলে সে তার বৈধতা হারাবে। এ কারণেই ঐশী প্রতিনিধি ও নবিগণ কখনও নিজেকে আল্লাহর সমকক্ষ ও সমমর্যাদা দানের মত অংশীবাদী চিন্তা করতে পারেননা। তেমনি কোন নবীর ওয়াসি ও প্রতিনিধি ঐ নবীর ওপর শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করতেপারেন না।
যদিও এ কথা ঠিক যে,ঐশী প্রতিনিধি যখন স্রষ্টার প্রতিনিধি হবেন তখন তাঁর সকলসুন্দর নামসমূহেরও প্রকাশস্থল হবেন,কিন্তু আল্লাহর কিছু পূর্ণতার গুণ রয়েছে যেগুলো কেবল তাঁর সত্তার জন্যই নির্দিষ্ট। কোন সত্তা ও ব্যক্তিই তা লাভ করতে পারে না। যেমন আল্লাহর ‘ইলাহ’ বা উপাস্য হওয়া এবং নিরঙ্কুশ শ্রেষ্ঠত্বের(কিবরীয়া) অধিকারী হওয়া। কোন সৃষ্টিকেই এ নাম ও বৈশিষ্ট্যে অভিহিত করা যাবেনা। কারণ,তা সুস্পষ্ট শিরক।১ এ বিষয়ে আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)-এর নিকট থেকে বর্ণিত হয়েছে : ‘নিজেকে মর্যাদার ক্ষেত্রে আল্লাহর সমকক্ষ গণ্য কর না এবং শ্রেষ্ঠত্ব ও পরাক্রমে কাউকে তাঁর সদৃশ জ্ঞান কর না। কারণ,আল্লাহ্ প্রত্যেক অহংকারী ও শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদারকে লাঞ্ছিত করবেন এবং প্রত্যেক স্বার্থপর কল্পনাবিলাসীকে হীন ও অপমানিত করবেন।’২
মহান আল্লাহরখেলাফতের রহস্য
সাধারণত খলিফা বলতে ঐ ব্যক্তিকে বুঝায় যে তার নিয়োগকারীর অনুপস্থিতিতে অথবা তার মৃত্যু (বা অন্তর্ধানের) পরবর্তী সময়ে তার দায়িত্ব গ্রহণ করে। মহান আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে এ প্রশ্ন আসে যে,যেহেতু আল্লাহ্ সকল সময় সকল স্থানে উপস্থিত৩ এবং তিনি সকল কিছুকে বেষ্টন করে রয়েছেন,৪ সেহেতু তাঁর জন্য অনুপস্থিতির চিন্তাও করা যায় না। তাহলে কেন তিনি প্রতিনিধি মনোনীত করেছেন? এ বিষয়টি স্পষ্ট যে,ঐশী প্রতিনিধিত্বের অর্থ বিশ্বজগতের পরিচালনা ও প্রভুত্বের দায়িত্ব গ্রহণ নয়। ঐশী প্রতিনিধিত্বের উদ্দেশ্যও এটি নয় যে,আল্লাহ্ তাঁর প্রতিনিধির জন্য কোন পদ ছেড়ে দেবেন;বরং এর অর্থ তাঁর বৈশিষ্ট্যসমূহের জন্য আয়না অর্থাৎ প্রতিফলক ও প্রকাশস্থল হওয়া। অর্থাৎ মহান আল্লাহ্ই স্থায়ী ও চিরন্তন পূর্ণ সত্তা হিসেবে প্রকৃত ও মৌলিক সত্য এবং মানুষ তাঁর নিদর্শনস্বরূপ। তাই মানুষ এক্ষেত্রে মহাসত্যের সকল বৈশিষ্ট্যের প্রদর্শক ও অর্জনকারী সত্তা। সে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে অন্য সকল সৃষ্টির ওপর কর্তৃত্বের অধিকারী। সুতরাং মানুষের ঐশী প্রতিনিধিত্ব অস্তিত্বগত-সময়গত নয়।
সাধারণত প্রতিনিধি গ্রহণের ও নিয়োগের দু’টি কারণ থাকে যার একটি নিয়োগকারীর সীমাবদ্ধতার কারণে এবং অপরটি যাদের মধ্যে বা যাদের জন্য প্রতিনিধি নিয়োগ করা হয়েছে তাদের সীমাবদ্ধতার কারণে।
স্থলাভিষিক্ত অর্থে প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি বিভিন্নভাবে প্রকাশিত হতে পারে,এমনকি আংশিক বা ক্ষুদ্র কোন বিষয়েও তা প্রযোজ্য হয়। এ ধরনের প্রতিনিধিত্ব হযরত হারুন (আ.) তাঁর ভাই হযরত মূসা (আ.)-এর নিকট থেকে লাভ করেছিলেন। যখন মূসা (আ.) সিনাই পর্বতে আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে গিয়েছিলেন তখন তাঁকে বনি ইসরাইলের মধ্যে নিজের স্থলাভিষিক্ত করেছিলেন। পবিত্র কুরআন এ বিষয়ের প্রতি ইশারা করে বলেছে : ‘মূসা তার ভাই হারুনকে বলল : আমার সম্প্রদায়ের মধ্যে আমার প্রতিনিধিত্ব কর এবং সংস্কার কর,আর বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের পথ অনুসরণ কর না।’৫
যেহেতু আল্লাহ্ অসীম হিসেবে সকল কিছুকে বেষ্টন করে রয়েছেন এবং সকল বিষয়ের সাক্ষী,সেহেতু তাঁর ক্ষেত্রে এরূপ প্রতিনিধিত্বের বিষয় অচিন্ত্যনীয়। কিন্তু কখনও কখনও প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি যাদের জন্য বা যাদের উদ্দেশে প্রতিনিধি হিসেবে প্রেরণ করা হয় তাদের অক্ষমতার কারণে হয়ে থাকে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে যাদের মধ্যে প্রতিনিধি প্রেরিত হবে তাদের যোগ্যতা ও ধারণক্ষ মতার সীমাবদ্ধতার কারণে প্রতিনিধি প্রেরণ অপরিহার্য হয়েছে। বিষয়টিকে এভাবেও বলা যায়,যেহেতু অন্যান্য মানুষ ও সৃষ্টি আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের উপযোগী নয় এবং তাদের ধারণক্ষমতা সীমিত,সেহেতু তারা এরূপ কোন প্রতিনিধির মাধ্যমে তাঁর অনুগ্রহ লাভ করে থাকে। যেমন নবিগণ ওহী লাভের উপযোগিতার অধিকারী,তাই তাঁরাই কেবল আল্লাহর পক্ষ থেকে তা পেয়ে থাকেন। অন্যান্য মানুষের তা পাওয়ার যোগ্যতা নেই বলেই তারা তা পায় না।
 খেলাফতের প্রকারভেদ
ঐশী প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে খেলাফতের বিষয়টি প্রতিনিধি নিয়োগকারী অর্থাৎ মহান আল্লাহর বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন ও প্রকাশ ছাড়া অন্য কিছু নয়। এ প্রতিফলন ও প্রকাশের মাত্রার পার্থক্যের কারণে প্রতিনিধিত্বের পর্যায়ের পার্থক্য ঘটে। প্রত্যেক মানুষই তার জ্ঞান ও কর্ম অনুযায়ী আল্লাহর সুন্দর নামসমূহের প্রকাশস্থল হয়ে থাকে। মানুষ এ দুই ক্ষেত্রে উৎকর্ষ লাভের মাধ্যমে পূর্ণতর প্রকাশস্থল হওয়ার উপযোগিতা লাভ করে।  যতই সে পূর্ণতার দিকে ধাবিত হয় ততই সে পূর্ণতার শীর্ষচূড়ার নিকটতর হয়। পূর্ণতম প্রকাশস্থল আল্লাহরপ্রথম প্রকাশস্থল (অস্তিত্ব ও মর্যাদাগত দৃষ্টিতে)। সে আল্লাহর নিকট থেকে কোনরূপ মাধ্যম ছাড়াই সকল অনুগ্রহ লাভ করে। ইসলামী জ্ঞানের উৎস অনুযায়ী যে পূর্ণতম সৃষ্টি আল্লাহর নিকট থেকে প্রত্যক্ষভাবে অনুগ্রহ লাভ করেন এবং তাঁর শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি,তিনি হলেন মহানবী(সা.),যিনি তাঁর সুন্দর নামসমূহের প্রথম সৃষ্টি ও প্রথম প্রকাশস্থল। অন্য সকল সৃষ্টি তাঁর মাধ্যমে আল্লাহর প্রতিনিধি। যেমন হযরত আদম (আ.) মহানবী (সা.)-এর প্রতিনিধি হিসেবে আল্লাহর প্রতিনিধি বলে বিবেচিত। আল্লাহর শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধির সমগ্রঅস্তিত্ব আল্লাহর মুখাপেক্ষী ও তাঁর ওপর পূর্ণ নির্ভরশীল। তাঁর অস্তিত্বের কোন স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা নেই। তিনি নিজেকে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর নিকট সমর্পণ করেছেন অর্থাৎ তিনি স্রষ্টার আয়না হিসেবে তাঁর সকল বৈশিষ্ট্যকে প্রতিফলিত করছেন। তাই তিনি স্রষ্টার জন্য বিলীন হওয়া এক সত্তা। তাই তাঁর প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি অন্য যারা পরোক্ষ প্রতিনিধি তাদের প্রতিনিধিত্বের পথে অন্তরায় নয়। সুতরাং তিনি পূর্ণতম প্রতিনিধি হলেও অন্য পূর্ণ প্রতিনিধিরাও রয়েছেন।৬
ঐশী প্রতিনিধির প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্র
মানুষের প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্র সম্পর্কে দু’টি মত রয়েছে। একটি মতে মানুষের প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্র হল শুধু পৃথিবী।৭ অপর মতে মানুষের প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি পৃথিবীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় এবং এ প্রতিনিধিত্ব সমগ্র অস্তিত্বজগতে ব্যাপৃত।৮
 انی جاعل فی الارض خلیفة আয়াতাংশের পূর্বের ও পরের আয়াতগুলোর ধরন ও তার থেকে যে সামগ্রিক অর্থ পাওয়া যায় এবং এ আয়াতের ব্যাখ্যাস্বরূপ বর্ণিত হাদীস সমূহ থেকে বোঝা যায় যে,এ প্রতিনিধিত্ব অত্যন্ত ব্যাপক। বিশেষত হযরত আদম (আ.)-এর সামনে সকল ফেরেশতা,এমনকি বিশ্বজগতের পরিচালনায় নিয়োজিত ফেরেশতাদের সিজদায় অবনত হওয়া,মানুষের এমন এক সত্তার প্রতিনিধি হওয়ার ঘোষণা দান যার অস্তিত্ব ও পূর্ণতা অসীম ইত্যাদি বিষয়কে এ দাবির সপক্ষে ব্যাখ্যারূপে উপস্থাপন করা যায়। এ দৃষ্টিতে মানুষ সমগ্র অস্তিত্বজগতে আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি এবং আয়াতে যে فی الارض অংশ এসেছে তা প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি সীমিত বা নির্দিষ্ট করার জন্য নয়;বরং নিযুক্তির স্থান ও কেন্দ্রের উল্লেখ মাত্র,যেখানে সে তাঁর সুন্দর নাম সমূহের প্রতিবিম্ব হিসেবে আবির্ভূত হবে। যদি মানুষ শুধু পৃথিবীতেই আল্লাহর প্রতিনিধি হয়,তবে ফেরেশতারা আকাশ ও ঊর্ধ্বজগতে তাঁর প্রতিনিধি হওয়ার সাথে কোন বৈপরীত্য থাকত না। সেক্ষেত্রে মানুষকে শ্রেষ্ঠত্ব দানের জন্য ফেরেশতাদের আদম (আ.)-কে সিজদার নির্দেশ ও এ নির্দেশ তাঁদের পক্ষ থেকে মেনে নেওয়ার ঘটনাটি মূল্যহীন হয়ে পড়ে। তেমনি ফেরেশতাদের বিশ্বজগতের জন্য রহস্যরূপে বিদ্যমান নামসমূহ সম্পর্কে অবহিত করার বিষয়টিও মানুষের ঐশী প্রতিনিধিত্বের অন্যতম কারণ। সুতরাং মানুষ মহান আল্লাহর সকল সুন্দর নাম ও বৈশিষ্ট্যের প্রতিবিম্ব। এরূপ ব্যাপক ধারণ ক্ষমতার সাথেই সীমাহীন সত্তার প্রতিনিধিত্ব ধাপ খায়।
ঐশী প্রতিনিধিত্বের স্তর ও পর্যায়সমূহ
ঐশী প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি একটি পর্যায়গত বিষয়। যে সত্তা ঐশী বৈশিষ্ট্যসমূহ ধারণ করবে তার ধারণ ক্ষমতা ও উপযোগিতা অনুযায়ী তার প্রতিনিধিত্বের পর্যায়ে পার্থক্য ঘটবে। ঐশী প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে সার্বিকভাবে চারটি স্তর কল্পনা করা যায় :
১. ক্ষণস্থায়ী প্রতিনিধিত্ব : যদি ঐশী পূর্ণতার বৈশিষ্ট্যসমূহ কোন ব্যক্তির মধ্যে ক্ষণস্থায়ীভাবে বিদ্যমান থাকে অর্থাৎ কখনও কখনও তার মধ্যে এমন বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ ঘটে বা প্রায়শই বিভিন্ন অবস্থায় সে পূর্ণতাসূচক কর্ম করে,কিন্তু এ বৈশিষ্ট্যতার নিকট থেকে বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা পূর্ণ মাত্রায় বহাল থাকে,তবে সে ক্ষণস্থায়ী প্রতিনিধিত্বের অধিকারী।
২. দীর্ঘস্থায়ী বা স্বভাবগত পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব : যদি কারও মধ্যে পূর্ণতার বৈশিষ্ট্য এমন মাত্রায় থাকে যে,বলা যায়,এটি তার স্বভাবে পরিণত হয়েছে,কিন্তু ঐ বৈশিষ্ট্যগুলো বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা এখনও রয়েছে,তবে এরূপ প্রতিনিধিত্বকে স্বভাবগত বা দীর্ঘস্থায়ী প্রতিনিধিত্ব বলা যায়।
৩. সত্তাগত পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব : যদি পূর্ণতার বৈশিষ্ট্যসমূহ কারও মধ্যে এমনপর্যায়ে থাকে যে,তার সত্তা গঠনকারী উপাদানে পরিণত হয়,তবে তার প্রতিনিধিত্বকে সত্তাগত পর্যায়ের বলা যায়।
৪. অস্তিত্বগত পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব : যদি পূর্ণতার বৈশিষ্ট্যসমূহ কারও অস্তিত্বের সঙ্গেএমনভাবে মিশে যায় যে,তাকে পৃথক করা অসম্ভব অর্থাৎ তার সমগ্র অস্তিত্বই পূর্ণতার বৈশিষ্ট্য দ্বারা গঠিত হয়,তবে তার প্রতিনিধিত্ব অস্তিত্বগত পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব। এ পর্যায়ে পৌঁছার অর্থ হল,সে কার্যত স্রষ্টার কান,চোখ ও হাতে পরিণত হয়েছে। এটি পূর্ণতার সর্বোচ্চ পর্যায়। এমন পূর্ণ মানবের সত্তা ও বৈশিষ্ট্য একীভূত অর্থাৎ তার অস্তিত্ব ও বৈশিষ্ট্য অমিশ্র ও মৌলে পরিণত হয়েছে। মহান আল্লাহর সত্তা ও বৈশিষ্ট্য যেমন একে অপর থেকে পৃথক নয়; বরং তাঁর সত্তা ও সকল বৈশিষ্ট্য নিরঙ্কুশভাবে একক ও অসীম এক অস্তিত্ব যাতে (আরোপিত) বৈশিষ্ট্যসমূহ বলতে কিছুই নেই- যা আছে তা কেবল নিরেট অস্তিত্ব,তেমনি এমনপূর্ণ মানব তাঁর দর্পণ হওয়ার কারণে তার সত্তাও বৈশিষ্ট্যশূন্য এ অর্থে যে,তার অস্তিত্ব ও বৈশিষ্ট্য একই-পরস্পর পৃথক কিছু নয়।৯
হযরত আলী (আ.) আল্লাহর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলেছেন : ‘পূর্ণ ইখলাস (নিখাঁদ তাওহীদী বিশ্বাস) হল আল্লাহর জন্য কোন (আরোপিত) বৈশিষ্ট্য নাকচ করা।’১০
সুতরাং পূর্ণতম তাওহীদী বিশ্বাসের জন্য মহান আল্লাহকে সকল (আরোপিত) বৈশিষ্ট্য থেকে মুক্ত মনে করতে হবে। বিশ্বাসের এ বিষয়টি ব্যবহারিক ক্ষেত্রে প্রয়োগের মাধ্যমে কর্মগত তাওহীদ অর্জিত হয়। পূর্ণ মানব নিজের বৈশিষ্ট্যকে তার অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করার মাধ্যমে স্রষ্টার বৈশিষ্ট্যসমূহের পূর্ণ প্রতিবিম্ব ও নিদর্শন হয় এবং স্রষ্টার সত্তার উপমায় রূপান্তরিত হয়,যেমনটি আল্লাহ্ বলেছেন: له المثل الاعلی فی السماوات والارض অর্থাৎ তাঁর জন্যই আকাশসমূহ ও পৃথিবীতে সর্বশ্রেষ্ঠ উপমা রয়েছে।১১ পূর্ণতম মানব মহান আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ উপমা যার মধ্যে স্রষ্টার সকল বৈশিষ্ট্যের পূর্ণ প্রতিফলন ঘটেছে।
ঐশী প্রতিনিধিত্ব অব্যাহত থাকা
পবিত্র কুরআন ও হাদীসসমূহ থেকে প্রমাণিত যে,পৃথিবীর বুকে সকল সময় মহান আল্লাহর একজন পূর্ণতম প্রতিনিধি রয়েছেন। কোন সময়ই পৃথিবী তাঁর এমন প্রতিনিধি-যাঁর মধ্যে তাঁর সকল সুন্দর নাম সমূহের প্রতিফলন ঘটেছে-থেকে শূন্য থাকতে পারে না। মহান আল্লাহ্ হযরত আদমকে সৃষ্টির পূর্বে ফেরেশতাদের এ কথাই বলেছেন। কারণ,তিনি বলেছেন : انی جاعل فی الارض خلیفة অর্থাৎ ‘অবশ্যই আমি পৃথিবীতে খলিফা নিযুক্তকারী।’ جاعل (নিযুক্তকারী) শব্দটি কর্তৃবাচক যা আরবি ব্যাকরণে অব্যাহতভাবে কর্তার নিকট থেকে এরূপ কর্ম সংঘটিত হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত করে। অর্থাৎ মহান আল্লাহ্ কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহতভাবে কাউকে না কাউকে এমন প্রতিনিধি হিসেবে প্রেরণ করতে থাকবেন। সুতরাং খেলাফতের এ বিষয়টি সাময়িক কোন বিষয় নয়;বরং আল্লাহ্ হযরত আদম (আ.)-কে এরূপ বৈশিষ্ট্যের একটি নমুনা হিসেবে ফেরেশতাদের সামনে পেশ করেছেন। অন্যদিকে সৃষ্টিজগৎ তার অস্তিত্বগত সীমাবদ্ধতার (ধারণক্ষমতার ক্ষেত্রে) কারণে স্রষ্টার নিকট থেকে সরাসরি অনুগ্রহ লাভে সক্ষম নয়। এ কারণে তারা পূর্ণ মানব ও আল্লাহর হুজ্জাতের মুখাপেক্ষী। ফেরেশতামণ্ডলী আল্লাহর অনুগ্রহ-ধন্য হলেও পূর্ণ মানবরা যে বিশেষ অনুগ্রহের অধিকারী,তাঁরা তা লাভ করতে সক্ষম নন। কারণ,অস্তিত্বগতভাবে পূর্ণ মানবদের মর্যাদা ফেরেশতাদের থেকে ঊর্ধ্বে। কিন্তু এরূপ পূর্ণ মানবের সংখ্যা খুবই কম। আলী (আ.) বলেন : ‘হ্যাঁ,কখনই পৃথিবী এমন অভিভাবক (মানব জাতি ও সৃষ্টির ওপর আল্লাহর নিদর্শন)-যিনি আল্লাহর জন্য স্পষ্ট প্রমাণ নিয়ে উত্থিত হবেন-বিহীন থাকে না। তিনি (সেই অভিভাবক) প্রকাশিত ও পরিচিত অথবা ভীতির কারণে লুক্কায়িত ও অপ্রকাশিত। এটি এজন্য যে,যেন আল্লাহর দলিল ভ্রান্ত ও বৃথা(প্রমাণিত) না হয় এবং তাঁর নিদর্শনসমূহ বিলুপ্ত না হয়। তাঁদের সংখ্যা কত নগণ্য! এবং তাঁরা কোথায়? আল্লাহর শপথ,তাঁরা সংখ্যায় খুবই কম। কিন্তু তাঁরা আল্লাহর নিকট মর্যাদায় অনেক উচ্চ। আল্লাহ্ তাঁদের মাধ্যমে তাঁর প্রমাণ ও নিদর্শনসমূহকে সংরক্ষণ করেন... তাঁরা পৃথিবীর বুকে আল্লাহর মনোনীত প্রতিনিধি এবং তাঁর ধর্মের দিকে মানুষকে আহবানকারী। আহ ! আহ ! আমি তাঁদের দেখার জন্য কত উদগ্রীব!’১২
সুতরাং কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর মনোনীত এমন প্রতিনিধিরা রয়েছেন এবং ফেরেশতামণ্ডলী তাঁদের সামনে সিজদায় অবনত। এটি ফেরেশতামণ্ডলীর ওপর তাঁদের শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ।
উপসংহার
খেলাফত অর্থ কোন কিছুর অপর বস্তুর পশ্চাতে আগমন এবং ঐশী প্রতিনিধিত্বের অর্থ পৃথিবীতে মানুষের আল্লাহর স্থলাভিষিক্ত হওয়া। ঐশী প্রতিনিধিত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন মতবিদ্যমান। এ প্রবন্ধে উল্লেখযোগ্য মতসমূহ নিয়ে আলোচনা ও পর্যালোচনা করা হয়েছে। ঐশী প্রতিনিধিত্ব সম্পর্কে সূরা বাকারার ৩০ নং আয়াত থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে,পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি হল হযরত আদম (আ.) ও তাঁর সন্তানরা। তাদের প্রতিনিধিত্বের পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক এবং সমগ্র আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী তাদের প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্র। ফেরেশতারা মানুষের ঐশী প্রতিনিধিত্বের রহস্য সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। কিন্তু যখন হযরত আদম (আ.) তাঁদের নামসমূহ সম্পর্কে অবহিত করলেন তখন তাঁরা মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ জানলেন। ফেরেশতারা হযরত আদম (আ.)-কে মানুষের মধ্যে যে সকল পূর্ণ মানব আসবেন তাঁদেরকে প্রতিনিধি হিসেবে সিজদা করেছিলেন। পবিত্র কুরআনে ‘নামসমূহ’ বলতে কাদের বুঝানো হয়েছে,এ সম্পর্কে মুফাস্সিরদের নিকট থেকে বিভিন্ন মত বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু যেহেতু ফেরেশতারা বিশ্বজগতের পরিচালনার দায়িত্ব পালন করা সত্ত্বেও এ সকল নাম সম্পর্কে অনবহিত ছিলেন,সেহেতু বলা যায়,নামসমূহ ফেরেশতাদের ঊর্ধ্বের জগতের সত্তা ছিলেন। এ বিষয়ে আমাদের মত হল : ঐ নামসমূহ সৃষ্টিজগতের মূল ও উৎসরূপ ভাণ্ডার যাকে ‘ঐশী বাস্তব সত্তা’ বলা যেতে পারে। এ সম্পর্কে অবহিতিই হযরত আদমকে ফেরেশতাদের ওপর শ্রেষ্ঠত্বদান করেছিল এবং হযরত আদমের সন্তানরা যারা কিয়ামত পর্যন্ত আসবে তাদের মধ্যে একটি দল পূর্ণ মানব হিসেবে ঐ নামসমূহ সম্পর্কে অবহিত এবং অপর দল অর্থাৎ বাকী সকলের মধ্যে ঐ নামসমূহকে জানার যোগ্যতা থাকার কারণে তারাও ঐশী প্রতিনিধিত্বের যোগ্যতা রাখে। যদি তারা ঐশী গুণাবলি অর্জন করতে সক্ষম হয়,তবে বাস্তবে তারা ঐশী প্রতিনিধিত্বের অধিকারী হবে। সুতরাং মানুষের মধ্যে যে যতটুকু ঐশী বৈশিষ্ট্যের দর্পণ হবে ও আল্লাহর গুণাবলি অর্জন করবে সে তার পর্যায়ে(ধারণক্ষমতা অনুযায়ী) ঐশী প্রতিনিধিত্বের আসন লাভ করবে। এক্ষেত্রে পূর্ণতম মানব আল্লাহর মহিমান্বিত,গরিমাময় ও উপাস্য হওয়ার বৈশিষ্ট্য ব্যতীত সকল বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। অন্যান্য পূর্ণ মানব তাঁদের ধারণক্ষমতা অনুযায়ী আল্লাহর সকলগুণ ধারণ করেন এবং মুমিনরাও তাদের ধারণক্ষমতা অনুযায়ী সকল অথবা আংশিকভাবে আল্লাহর বৈশিষ্ট্যসমূহ অর্জন করে। তাদের কেউ ঐ বৈশিষ্ট্যকে তার অভ্যাসে,কেউ তার সত্তায়,আবার কেউ তার অস্তিত্বের অংশে পরিণত করে। মহানবী (সা.) আল্লাহর প্রথম ও পূর্ণতম সৃষ্টি হিসেবে আল্লাহর সকল বৈশিষ্ট্যের ও সুন্দর নামসমূহের দর্পণ এবং তাঁর ন্যায় সকল (আরোপিত) বৈশিষ্ট্য থেকে মুক্ত। অর্থাৎ আল্লাহর দর্পণ হিসেবে তার সত্তা ও বৈশিষ্ট্যও একীভূত ও অবিভাজ্য এক অস্তিত্বে পরিণত। সুতরাং তিনি আল্লাহর শ্রেষ্ঠ ও উজ্জ্বলতম খলিফার দৃষ্টান্ত। পবিত্র ইমামগণ ও অন্য সকল নবী তাঁর প্রতিনিধি হওয়ার কারণে আল্লাহর খলিফা বলে বিবেচিত। এ ক্ষেত্রে তাঁরা সকলেই আল্লাহর হুজ্জাত ও নিদর্শন,যদিও তাঁদের মধ্যে পর্যায়গত পার্থক্য রয়েছে।(সমাপ্ত)
অনুবাদ : এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
তথ্যসূত্র
১. বিস্তারিত জানতে দেখুন আয়াতুল্লাহ জাওয়াদী আমূলী,তাফসীরে তাসনীম,৩য় খণ্ড,পৃ. ১০১-১০৪,প্রকাশকাল ১৩৮০ ফারসি সাল,ইসরা প্রকাশনী,কোম,ইরান।
২. নাহজুল বালাগা,পত্র ৫৩
৩. এক্ষেত্রে এ আয়াতগুলো লক্ষণীয় : ‘তোমরা যেদিকেই মুখ ফিরাও আল্লাহ সেদিকেই রয়েছেন’ (সূরা বাকারা : ১১৫); ‘তোমরা যেখানেই থাক না কেন,তিনি তোমাদের সঙ্গে রয়েছেন’ (সূরা হাদীদ : ৪);‘যারাই এতে (পৃথিবীতে) রয়েছে তারা ধ্বংসশীল এবং কেবল প্রতাপ ও সম্মানের অধিপতি তোমার প্রতিপালকের সত্তা অবিনশ্বর’(সূরা আর রহমান : ২৬-২৭)‘
৪. জেনে রাখ,তিনি (আল্লাহ) সকল কিছুকে বেষ্টন করে রয়েছেন’ (সূরা হা-মীমসিজদাহ : ৫৪);এবং বস্তুত আল্লাহ সকল কিছুকে বেষ্টন করে রয়েছেন’ (সূরানিসা : ১২৬)
৫. সূরা আরাফ : ১৪২
৬. আয়াতুল্লাহ জাওয়াদী আমূলী,তাফসীরে তাসনীম,৩য় খণ্ড,পৃ. ১০৪-১০৭
৭.রাশিদ রিদা,তাফসীরে আল মানার,১ম খণ্ড,পৃ. ২৫৮,দারূল ফিকর প্রকাশনী,বৈরুত,১৪১৪ হিজরি।
৮. আয়াতুল্লাহ জাওয়াদী আমূলী,তাফসীরে তাসনীম,৩য় খণ্ড,পৃ. ১০৮।
৯. প্রাগুক্ত,পৃ. ৯২-৯৯
১০. নাহজুল বালাগা,খুতবা ১।
১১. সূরা রূম : ২৭।
১২. নাহজুল বালাগা,সংক্ষিপ্ত বাণী ১৪৭
(প্রত্যাশা’, ১ম বর্ষ ৪র্থ সংখ্যা)

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

মিথ্যা কথা বলা
শিয়া-সূন্নীর মধ্যে পার্থক্য কি?
কুরআনে প্রযুক্তি [পর্ব-০2] :: ...
দরিদ্রতার চেয়ে মৃত্যু ভাল
ইফতার ও সেহরীর সময়সীমা
রহমত মাগফেরাত আর নাজাতের মাস : ...
ধর্ম ও রাজনীতি
শিয়া মুসলমানরা কত ওয়াক্ত নামাজ ...
হিজাব সমাজকে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন ...
ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে হিংসার ...

 
user comment