বাঙ্গালী
Friday 19th of April 2024
0
نفر 0

ইসলামের সর্বজনীন ঐক্যচিন্তা

ইসলামের সর্বজনীন ঐক্যচিন্তা

পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্টভাবে এই নীতি ঘোষণা করা হয়েছে যে, ইসলাম কোন নতুন ধর্ম নয়। কেননা, সমগ্র ইতিহাসে ধর্ম কেবল একটাই মনোনীত করা হয়েছে। প্রত্যেক নবীকে সময়ের প্রেক্ষাপট ও যুগের চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রেখে এই ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য নিয়োগ করা হয়েছে।

এই একটিমাত্র ধর্মই মনোনীত হয়েছে যার নাম হচ্ছে আত্মসমর্পণ বা ‘ইসলাম’। এই ঘোষণার মাধ্যমেই মহানবী (সা.) এই ধর্মকে বিশ্বব্যাপী প্রচার করেছেন। তিনি আত্মসমর্পণের ধারণাকে একটি সর্বজনীন ও ঐতিহাসিক মতবাদ হিসাবে তুলে ধরেছেন। তিনি ইসলামী আন্দোলনকে মানবতার মুক্তির সংগ্রাম বলে বর্ণনা করেছেন। নবী-রাসূলগণ শক্তিমান, সম্পদশালী ও পথভ্রষ্টদের মোকাবিলা করার উদ্দেশ্যেই দণ্ডায়মান হয়েছিলেন। তাঁরা স্থান, কাল ও প্রজন্ম নির্বিশেষে সমগ্র মানবেতিহাসে এক আধ্যাত্মিক সংগ্রাম, এক ধর্ম, এক চেতনা ও একই স্লোগান দিয়ে একটি একক দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ রেখে গেছেন।

পবিত্র কুরআন কিভাবে ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত বর্ণনা করেছে এবং কিভাবে একের পর এক এসব সংগ্রাম চলেছে তা জানার জন্য আমরা খোদ পবিত্র কুরআনেরই নিম্নোক্ত আয়াতটির দিকে দৃষ্টিপাত করতে পারি :

‘যারা আল্লাহর নিদর্শন প্রত্যাখ্যান করে, অন্যায়ভাবে নবীদের হত্যা করে এবং মানুষের মধ্যে যারা ন্যায়পরায়ণতার নির্দেশ দেয় তাদেরকে হত্যা করে…’ (সূরা আলে ইমরান : ২১)

আমরা দেখতে পাই যে, এই আয়াতটিতে তিনটি বিষয়ের একটিকে অপরটির সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে। প্রথমত আল্লাহ তাআলার নিদর্শন; দ্বিতীয়ত নবী-রাসূলগণ এবং তৃতীয়ত সেসব লোক যারা অবিশ্বাসীদের বিরোধীতা করে মানুষকে সমতা বা সাম্যের দিকে আহ্বান জানায়। নবী-রাসূলগণ একটি বাণী বহন করে আনেন। তাঁদের বাণী ইল্‌ম, কিতাব ও মানবতার প্রতি ইনসাফ নিয়ে গঠিত। মহানবী (সা.) ছিলেন দুনিয়ার শেষ নবী। তিনি ইসলাম বা আত্মসমর্পণ নাম দিয়ে একটি মানবতাবাদী আন্দোলনের সূচনা করে মানুষকে আল্লাহর দাসত্ব করার আহ্বান জানান যাতে তারা আল্লাহকে ছাড়া আর কারো দাসত্ব না করার ব্যাপারে স্বাধীনতা ভোগ করে।

ইসলামী ঐক্যের স্লোগান ছিল এমন এক স্লোগান যা মানুষকে স্বাধীনতা দিয়েছিল। বুদ্ধিজীবী, পণ্ডিত, শিক্ষিত ও দার্শনিক ব্যক্তিবর্গ একথা বুঝার আগে দাস, মজলুম, অনাহারী ও অবহেলিত মানবকুল তা জানতে পেরেছিল। এটি এই কারণে যে, মক্কায় মুহাম্মাদ (সা.)-এর আশেপাশে যারা সমবেত হয়েছিল তাদের অধিকাংশই ছিল সমাজের বঞ্চিত, অবহেলিত ও ছিন্নমূল মানুষ। মহানবী (সা.) দাসদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন।

এর আগে সমগ্র ইতিহাসে দাসদের ভাগ্য নির্দিষ্ট ছিল কেবল দাসত্ব করার জন্য। কবিতা বা চিত্রকর্ম ব্যবহার করে ধর্ম, বিজ্ঞান ও দর্শনের ভাষায় দাস ও ছিন্নমূলদের বুঝানো হয়েছিল যে, তাদের ভাগ্য নির্ধারিত হয়েছে প্রভুদের সেবা করার জন্য। দাসরা এর ফলে এই বিশ্বাস পোষণ করত যে, তাদের জীবন হলো কেবল দুঃখ-কষ্ট ভোগ করা, ভারী বোঝা বহন করা এবং ক্ষুধার্ত থাকার জন্য যাতে অন্যরা আনন্দ লাভ করতে পারে। তারা মনে করত তাদের জন্ম ও সৃষ্টির উদ্দেশ্য এটাই।

এই বঞ্চিত শ্রেণি বিশ্বাস করত যে, দেব-দেবীরা ছিল তাদের শত্রু। তারা এও বিশ্বাস করত যে, দুনিয়ার যাবতীয় অত্যাবশ্যকীয় কর্ম সম্পাদনের জন্যই তাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। দার্শনিক অ্যারিস্টটল ও প্লেটো বলেছেন : ‘খোদা ও প্রকৃতি কাউকে কাউকে সৃষ্টির দাস হিসাবে সৃষ্টি করেছেন। আর কাউকে কাউকে করেছেন স্বাধীন। যাতে দাসেরা সাধারণ কার্যাদি সম্পাদন করতে পারে আর স্বাধীন লোকেরা স্বাধীনভাবে নীতি-নৈতিকতা, কবিতা, সংগীত ও সভ্যতার মতো উন্নততর কর্মচর্চা করতে পারে।’

সমগ্র মানবেতিহাসে প্রতারণা, মিথ্যাচার, বহু ঈশ্বরবাদ (শির্‌ক), বিবাদ-বিসম্বাদ, মুনাফিকী, অহংবোধ ও শ্রেণিবৈষম্যের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন চলেছে তা সম্পূর্ণ করার জন্যই মহানবী (সা.)-কে মনোনীত করা হয়েছিল। একটি আধ্যাত্মিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সবকিছুকে একই লক্ষ্যাভিসারী করা হয় এবং ঘোষণা করা হয় যে, সমগ্র মানবতা একই বর্ণের, একই উতস থেকে এসেছে, সকলের প্রকৃতি অভিন্ন এবং সকলেই এক আল্লাহর সৃষ্টি। আল্লাহ সকলের জন্যই সাম্য ঘোষণা করেছন। মহানবী (সা.) এ ব্যাপারে একটি সুন্দর দার্শনিক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন এবং একটি সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য শক্তিশালী অর্থনৈতিক শক্তির মোকাবিলা করেছেন।

সকলেই তাঁর এই অবস্থান মেনে নিয়েছে। অকস্মাত মদীনাবাসী আরব, ইহুদি, কুরাইশরা তাদের মাঝে দেখতে পেল যে, হোযায়ফার তরুণ দাসেরা তাদের মতোই সমান মর্যাদা পাচ্ছে। তিনি প্রায়শই সংকীর্ণ রাস্তা বেয়ে বর্তমানের কুবা মসজিদ স্থলে ছিন্নমূল ও বঞ্চিত দাসদের মাঝে যেতেন এবং সেখানে আগন্তুক মর্যাদাবান কুরাইশদের সামনে তাদের নামাযে ইমামতি করতেন। এর ফলে তিনি তাদের অত্যন্ত অপনজন ও এক দীপ্তিমান ব্যক্তিত্ব হতে পেরেছিলেন।

মহানবী (সা.) যখন অজ্ঞতা ও অহংবোধের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করেন তখন সমাজে প্রচলিত যাবতীয় মূল্যবোধ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। তিনি তাদের অহংকার ও আভিজাত্যের প্রতীক লম্বা আলখিল্লা ও বেমানান অতি লম্বা দাড়ি খাটো করার নির্দেশ দেন। তিনি লোকদেরকে গর্বভরে রাস্তায় হাঁটতে এবং ঘোড়ার পিঠে একসাথে দুই ব্যক্তিকে আরোহণ করতে নিষেধ করেন। কখনও কখনও তিনি তথাকথিত আভিজাত্যবোধকে ভেঙে দেয়ার জন্য গাধার খালি পিঠে আরোহণ করতেন।

একদিন এক বৃদ্ধা মহিলা মহানবী (সা.)-এর কাছে আগমন করেন। তিনি অনেক বছর আগে থেকেই মহানবী (সা.)-এর মহত্ত্ব ও বিশেষত্ব সম্পর্কে শুনেছিলেন। মহানবী (সা.)-এর সামনে উপস্থিত হয়ে বৃদ্ধা অত্যন্ত বাকসংযম অবস্থায় দণ্ডায়মান হয়েছিলেন। মহানবী (সা.) অত্যন্ত বিনয়, দয়া ও সহজ ভঙ্গিতে তাঁকে বলেন, ‘আপনি ভয় পাচ্ছেন কেন? আমি কুরাইশ মহিলাদের সন্তান যারা ভেড়ার দুধ পান করাতো। আপনার কিসের ভয়?’

মরুভূমির নীরবতার মধ্য থেকে আকস্মিকভাবে আবির্ভূত এবং নগরীর ক্ষমতা ও সম্পদের মালিক ও প্রবঞ্চকদের ওপর আঘাতকারী শেষনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) যখন মৃত্যুবরণ করেন তখন হঠাত করে সবকিছু পরিবর্তিত হয়ে যায়। তাঁর ইন্তেকালের সাথে সাথেই অনৈক্য দেখা দেয়। সূচনাকালে অবশ্য ইসলামের মাজহাব ও ঘটনা প্রবাহ নিয়ে এবং সত্য ও মিথ্যা প্রশ্নে বিরোধ ছিল সামান্য। কিন্তু মহানবী (সা.)-এর তিরোধানের পর এই বিরোধ ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হতে থাকে। এই ব্যবধান দৃষ্টে মনে হয়, দু’টি রেখা প্রথমে একটি কোণে মিলিত হয়েছে এবং পরে ধীরে ধীরে তা যত লম্বা হয়েছে ততই তার ব্যবধান বেড়েছে।

বর্তমানে এই বিভক্তি ও অনৈক্য মুসলিম সমাজকে দুর্বল করেছে এবং ইসলাম ধর্ম, এমনকি মুসলমানদেরকে তাদের আবাসভূমি থেকে বিতাড়িত করতে ইসলামের দুশমনদের উতসাহিত করেছে।

এই বেদনাদায়ক পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে হলে মুসলমানদেরকে সকল মাজহাবী মতপার্থক্য ও বিরোধ ত্যাগ করে ঐক্যবদ্ধ মুসলিম উম্মাহ গঠনের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো ছাড়া আর কোন পথ নেই।

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

খলিফা নির্বাচনের পদ্ধতি
‘বাতিলের মুকাবিলায় ঐক্যই ...
অর্থসহ মাহে রমজানের ৩০ রোজার দোয়া
কোরআন ও চিকিৎসা বিজ্ঞান
শিয়াদের মৌলিক বিশ্বাস (পর্ব-১)
সূরা ইউনুস;(১৭তম পর্ব)
মহানবী (স.) হতে বর্ণিত ৪০টি হাদীস (২)
পরকালের জন্য প্রস্তুতি এবং ...
মুবাহেলা
ইমাম মাহদী (আ.)এর আগমন একটি অকাট্য ...

 
user comment