বাঙ্গালী
Friday 19th of April 2024
0
نفر 0

নাহজুল বালাগায় ‘ইবাদত ও আধ্যাত্মিক পরিক্রমণ’

নাহজুল বালাগায় ‘ইবাদত ও আধ্যাত্মিক পরিক্রমণ’

ইসলাম ধর্মে ইবাদত

এক-অদ্বিতীয় মহান আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী এবং অন্য সকল সত্তার উপাসনা বর্জন মহান নবী-রাসূলদের যাবতীয় শিক্ষার মৌলিক ভিত্তিস্বরূপ। কোন নবীরই শিক্ষা ইবাদতবর্জিত ছিল না।

যেমনি আমরা জানি যে,পবিত্র ইসলাম ধর্মেও সকল ঐশী শিক্ষা ও নীতির শীর্ষে রয়েছে ইবাদতের স্থান ঠিক তেমনি নিছক আখেরাত বা পরকালের সাথে সংশ্লিষ্ট এ পার্থিব জগৎ ও জীবন থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন কতগুলো শিক্ষা ও নীতির অবয়বে ইসলাম ধর্মে কোন ইবাদতেরই অস্তিত্ব নেই। ইসলাম ধর্মে স্বীকৃত ইবাদত জীবন-দর্শনের সাথে পরিপূর্ণরূপে সম্পৃক্ত এবং মানব জীবনের গভীরে তা সুপ্রোথিত।

ইসলাম ধর্মের কতিপয় ইবাদত জামায়াতবদ্ধভাবে অর্থাৎ সামষ্টিকভাবে সম্পন্ন করা ছাড়াও ব্যক্তিগত পর্যায়ে যে সব ইবাদত সম্পন্ন করা হয় ইসলাম সেগুলোকেও এমন আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছে যে,সেগুলোর মধ্যেও মানব জীবনের কতিপয় দায়িত্ব পালনের দিক রয়েছে। যেমন নামায-যা মহান আল্লাহর প্রতি দাসত্ব প্রকাশের পূর্ণাঙ্গ ও বাস্তব নমুনা সেটিও ইসলাম ধর্মে বিশেষ অবয়ব বা রূপ লাভ করেছে। এমনকি যে ব্যক্তি নীরবে-নিভৃতে একাকী নামায পড়তে ইচ্ছুক তাকেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা,অন্যদের অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন,সময় সংক্রান্ত জ্ঞান,দিক শনাক্ত করা সংক্রান্ত জ্ঞান,আবেগের সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ,মহান আল্লাহর সৎকর্মশীল বান্দাদের সাথে শান্তি ও বন্ধুত্বের ঘোষণা দানের ন্যায় বেশ কিছু নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব পালন করার ব্যাপারে নীতিগতভাবে বাধ্য থাকতে হয়।

ইসলাম ধর্মের দৃষ্টিতে প্রতিটি কল্যাণকর কাজ যদি পবিত্র ঐশ্বরিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সাথে সম্পৃক্ত হয় তাহলে তা হবে ইবাদত। এ কারণেই লেখা-পড়া শিখা,কাজ-কর্ম,ব্যবসায়-বাণিজ্য এবং সামাজিক কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করা যদি মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে ও তাঁর জন্যই হয়ে থাকে তাহলে তা ইবাদত বলে গণ্য হবে।

ঠিক একই সময় পবিত্র ইসলাম ধর্মে এমন কিছু শিক্ষা ও নীতি আছে যেগুলো কেবল ইবাদত-বন্দেগীর আচার-অনুষ্ঠানাদি পালন করার জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে। যেমন নামায ও রোযা। আর এগুলোর অন্তর্নিহিত বিশেষ দর্শনও আছে।

ইবাদতের ধাপ ও পর্যায়সমূহ

ইবাদত-বন্দেগী সংক্রান্ত সকল মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি এক নয়;বরং তা ভিন্ন ভিন্ন ধরনের। কতিপয় ব্যক্তির মতে ইবাদত-বন্দেগী এক ধরনের লেন-দেন এবং কাজ ও মজুরির মধ্যকার বিনিময় অর্থাৎ কর্ম বিক্রয় ও পারিশ্রমিক গ্রহণ। যেমনভাবে একজন শ্রমিক প্রতিদিন একজন নিয়োগকর্তার জন্য তার কর্মশক্তি ব্যয় করে এবং পারিশ্রমিক প্রাপ্ত হয় ঠিক তেমনি আবেদও (ইবাদতকারী) মহান আল্লাহর জন্য কষ্ট ও পরিশ্রম করে এবং সোজা ও বাঁকা (ঋজু) হয়;আর স্বভাবতঃই সে পারিশ্রমিক দাবি করে। অবশ্য এ পারিশ্রমিক তাকে পরকালে দেয়া হবে।

নিয়োগকর্তার নিকট থেকে শ্রমিক যে মজুরি গ্রহণ করে সে মজুরির মাঝেই এ শ্রমিকের শ্রম বা কর্মের মূল্যমান ও উপকারিতা নির্ণীত হয়। আর যদি পারিশ্রমিক বা মজুরির কথা বলাই না হয় অর্থাৎ তা যদি অনুল্লিখিত থাকে তাহলে তার শ্রম ও শক্তিই বৃথা হয়ে যাবে। এ দলটির মতে আবেদের ইবাদতও ঐ মজুরি যা তাকে পরকালে কতগুলো বস্তুগত জিনিস বা পণ্য আকারে প্রদান করা হবে।

তবে শ্রমিকের কাজ থেকে উপকৃত হওয়ার কারণেই নিয়োগকর্তা শ্রমিককে মজুরি প্রদান করে। কিন্তু সমগ্র সৃষ্টি ও মহিমাজগতের অধিপতি মহান আল্লাহ্ তাঁর দুর্বল ও অসহায় বান্দার কর্ম থেকে কোন্ ধরনের উপকার নিতে পারেন? আর যেহেতু ধরে নিই যে,মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মজুরি হচ্ছে তাঁর ঐশ্বরিক দান,অনুগ্রহ,ক্ষমা ও অবারিত দান,তাহলে বিন্দু পরিমাণ কর্মশক্তি ব্যয় না করেই তো বান্দাকে কেন এ অনুগ্রহ ও দান দেয়া হয় না?-এমন প্রশ্ন এ ধরনের আবেদের ক্ষেত্রে কখনই উত্থাপিত হয় না।

এ সব ব্যক্তির দৃষ্টিতে ইবাদতের মূল অবকাঠামোই হচ্ছে দৈহিক ক্রিয়াকলাপ ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাহ্য কর্মতৎপরতা;এ সব ক্রিয়াকলাপ কণ্ঠ ও দেহের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা সম্পন্ন হয়ে থাকে।

এটি হচ্ছে ইবাদত সংক্রান্ত এক ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি যা অবশ্য অজ্ঞতাপ্রসূত ও সাধারণ মানুষই তা পোষণ করে। ‘ইশারাত’গ্রন্থের নবম অধ্যায়ে এ আবু আলী ইবনে সীনার অভিমত অনুযায়ী ইবাদত সংক্রান্ত এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি আসলে মহান আল্লাহ্ সংক্রান্ত সঠিক জ্ঞান ও পরিচিতি না থাকার কারণেই সৃষ্টি হয়েছে। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি কেবল জনগণ থেকেই আশা করা যায় যারা নিতান্তই অপারগ ও অক্ষম ।

ইবাদত সংক্রান্ত অপর যে দৃষ্টিভঙ্গি প্রচলিত রয়েছে তা অবশ্য আধ্যাত্মিক সাধক অর্থাৎ আরেফদের দৃষ্টিভঙ্গি। এ দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী শ্রমিক,নিয়োগকর্তা ও মজুরির বিষয়টি যেভাবে শ্রমজীবী ও নিয়োগকর্তার মাঝে প্রচলিত আছে ঠিক সেভাবে মোটেও আলোচিত ও উত্থাপিত হয় না এবং হতেও পারে না। এ দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী ইবাদত মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের সোপান;মানুষের মেরাজস্বরূপ এবং মানবাত্মার উৎকর্ষ,বিকাশ ও উন্নতি বিধায়ক। এ ইবাদত হচ্ছে রূহ বা আত্মার অস্তিত্বের অদৃশ্য উৎসমূলের পানে উড্ডয়ন,আত্মিক যোগ্যতাসমূহের পরিচর্যা ও বিকাশ, মানুষের আধ্যাত্মিক শক্তিসমূহের সুষ্ঠু অনুশীলন,জড় দেহের ওপর অজড় আত্মার বিজয় এবং স্রষ্টার প্রতি মানুষের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। এ ইবাদত হচ্ছে নিরঙ্কুশ পরম পূর্ণ ও পরম সুন্দর সত্তার (আল্লাহর) প্রতি মানুষের হৃদয় নিংড়ানো ভক্তি,প্রেম ও ভালোবাসা এবং সবশেষে মহান আল্লাহর দিকে আধ্যাত্মিক পরিক্রমণ।

এ দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী ইবাদতের দু’ধরনের অবয়ব রয়েছে। একটি আধ্যাত্মিক যা গভীর অর্থ ও তাৎপর্যমণ্ডিত ও অপরটি বাহ্যিক। যা কিছু কণ্ঠ (জিহ্বা) ও দেহের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা আঞ্জাম দেয়া হয় তা হচ্ছে ইবাদতের বাহ্য অবয়ব;কিন্তু ইবাদতের রূহ ও প্রকৃত স্বরূপ হচ্ছে ভিন্ন একটি বিষয়। ইবাদতের রূহ বা প্রকৃত স্বরূপ ইবাদত সংক্রান্ত আরেফ যে ধারণা পোষণ করেন সেই ধারণার সাথে,ইবাদতকে তিনি যেভাবে বরণ করেন সেই ধরনের বরণের সাথে,যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তাঁকে ইবাদত করতে উদ্বুদ্ধ করেছে সেই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সাথে এবং ইবাদত থেকে বাস্তবে যে ধরনের কল্যাণ তিনি লাভ করেন সেই কল্যাণের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আর ইবাদত কি পরিমাণে মহান আল্লাহর দিকে পরিক্রমণ এবং তাঁর নৈকট্য লাভের ক্ষেত্রে কতটুকু পরিমাণ কার্যকর পদক্ষেপস্বরূপ এ বিষয়ের সাথেও ইবাদতের রূহ বা প্রকৃত স্বরূপের একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।

নাহজুল বালাগাহ্ ইবাদত সংক্রান্ত কী ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে

নাহজুল বালাগাহ্ ইবাদতকে কিভাবে বরণ করে নেয়? ইবাদত সংক্রান্ত নাহজুল বালাগার দৃষ্টিভঙ্গিটিই বা কি ধরনের? আসলে ইবাদত সংক্রান্ত নাহজুল বালাগার দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে আরেফগণ যেভাবে ইবাদতকে বরণ করেছেন এবং এ ক্ষেত্রে যে দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন ঠিক তদ্রূপ। বরং পবিত্র কোরআন ও মহানবীর (সা.)-এর সুন্নাহর পরেই ইসলামী বিশ্বে ইবাদত-বন্দেগীকে আধ্যাত্মিকতা সহকারে বরণ করার উৎস ও অনুপ্রেরণা স্থল হচ্ছে ইমাম আলী (আ.)-এর অমিয় বাণী ও তাঁর আধ্যাত্মিকতাপূর্ণ ইবাদত-বন্দেগীসমূহ।

আমরা ইতোমধ্যে জেনেছি যে,কি আরবী,কি ফার্সী ভাষায় রচিত ইসলামী সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও উৎকৃষ্ট দিক হচ্ছে মহান স্রষ্টার সাথে মানুষের প্রেমপূর্ণ ও আরাধনামূলক সম্পর্কের দিক। ভাষণ,দোয়া,উপমা,ইশারা-ইঙ্গিতের শিরোনামে অগণিত সূক্ষ্ম চিন্তাধারা পদ্য বা গদ্য আকারে এ ক্ষেত্রে লিখা হয়েছে যে,সত্যিই তা প্রশংসাযোগ্য ও চমকপ্রদ।

ইসলামী দেশসমূহের ইসলামপূর্ব চিন্তা ও ধ্যান-ধারণাসমূহের সাথে তুলনা করলেই স্পষ্ট বোধগম্য হয়ে যাবে যে,ইসলাম ধর্ম গভীর চিন্তা-ভাবনা ও সূক্ষ্ম ধ্যান-ধারণার ক্ষেত্রে কত ব্যাপক ও মহান উন্নয়ন ঘটিয়েছে! যে জনগণ প্রতিমা,মানুষ অথবা আগুনের পূজা করত এবং সংকীর্ণ চিন্তা ও ধ্যান-ধারণার কারণে নিজেদের হস্তনির্মিত প্রতিমাসমূহকে মাবুদ (উপাস্য) করে নিয়েছিল অথবা অবিনশ্বর মহান স্রষ্টাকে একজন মানুষের পিতার পর্যায়ে নামিয়ে এনে কখনো কখনো পিতা ও পুত্রকে এক ও অভিন্ন বলে বিশ্বাস করত অথবা আনুষ্ঠানিকভাবে আহুরা মাযদাকে দেহধারী মনে করে তার মূর্তি সর্বত্র স্থাপন করত তাদের থেকে পবিত্র ইসলাম ধর্ম এমন সব মানুষ সৃষ্টি করেছে যাঁরা নিজেদের মন-মানসিকতায় সবচেয়ে সূক্ষ্ম তাৎপর্য,চিন্তা ও শ্রেষ্ঠ ধ্যান-ধারণার স্থান দিয়েছেন।

কিভাবে চিন্তা-চেতনা ও ধ্যান-ধারণা রাতারাতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেল? কিভাবে যুক্তিগুলো পরিবর্তিত হয়ে গেল? কিভাবে চিন্তাধারা উন্নতির শীর্ষ চূড়ায় পৌঁছে গেল? কিভাবে আবেগ-অনুভূতিসমূহ বস্তুবাদিতার স্থূলত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে সূক্ষ্ম ও উন্নত হয়ে গেল? কিভাবে মূল্যবোধসমূহ সম্পূর্ণ পাল্টে গেল?

সাবআহ্-ই মুআল্লাকাহ্ (ঝুলন্ত কাব্যসপ্তক) ও নাহজুল বালাগাহ্ দু’টি পরপর প্রজন্মের সাহিত্যের প্রতিনিধিত্বকারী। দু’টিই অলংকারশাস্ত্র ও ভাষার প্রাঞ্জলতার সর্বোৎকৃষ্ট নিদর্শন। কিন্তু অর্থ,ভাব ও তাৎপর্যগত দিক থেকে এ দু’সাহিত্য কর্মের মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান রয়েছে। সাবআহ্-ই মুআল্লাকায় যা কিছু আছে তার সর্বস্বই হচ্ছে অশ্বস্তুতি,তীর-বর্শা,উষ্ট্র,আকস্মিক ক্ষিপ্র আক্রমণ,চক্ষু,আব্র“,নর-নারীর চটুল তরল প্রেমোপাখ্যান এবং বিভিন্ন ব্যক্তির প্রশংসা ও ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ। আর নাহজুল বালাগায় রয়েছে সর্বোচ্চ পর্যায়ের উন্নত শ্রেষ্ঠ মানবীয় ধ্যান-ধারণা ও চিন্তাধারা।

নাহজুল বালাগাহ্ ইবাদতকে কিভাবে বরণ করেছে তা স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার জন্য আমরা হযরত আলী (আ.)-এর বাণীসমূহ থেকে কতিপয় নমুনা এখানে পেশ করব। ইবাদতকে জনগণ যে বিভিন্নভাবে ও বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি সহকারে বরণ করে নেয় এতদসংক্রান্ত হযরত আলী (আ.)-এর বাণী দিয়েই আমাদের আলোচনা শুরু করব। স্বাধীন ও মুক্ত হৃদয়ের অধিকারী ব্যক্তিদের ইবাদত

“নিশ্চয়ই একদল লোক (পুরস্কার পাওয়ার) আশায় মহান আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করে। তাই তাদের ইবাদত হচ্ছে ব্যবসায়ীদের ইবাদত তুল্য;আরেক দল লোক আছে যারা (জাহান্নামের শাস্তির) ভয়ে মহান আল্লাহর ইবাদত করে। তাই তাদের ইবাদত দাসদের ইবাদত তুল্য;আর আরেক দল আছে যারা মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশস্বরূপ তাঁর ইবাদত করে,তাই তাদের ইবাদত মহান মুক্তমনা স্বাধীন ব্যক্তিদের ইবাদত।” (নাহজুল বালাগাহ্,সংক্ষিপ্ত জ্ঞানগর্ভমূলক বাণী নং ২৩৭)

যদিও ধরে নিই যে,মহান আল্লাহ্ তাঁর অবাধ্যতা ও বিরুদ্ধাচরণ করার জন্য শাস্তির ব্যবস্থা না-ও করতেন তবুও তাঁর (প্রদত্ত) নেয়ামতের প্রতি কৃতজ্ঞতা তাঁর আদেশ-নিষেধ অবমাননা না করার বিষয়টি অবধারিত করে দিত। ইমাম আলী (আ.)-এর বাণী :

“হে ইলাহ্! আমি না তোমার দোযখের আগুনের ভয়ে,আর না তোমার জান্নাত পাওয়ার লোভে তোমার ইবাদত করেছি,বরং আমি তোমাকে ইবাদতের যোগ্য পেয়েছি বলেই তোমার ইবাদত করেছি (করি)।” (নাহজুল বালাগাহ্,সংক্ষিপ্ত জ্ঞানগর্ভমূলক বাণী নং ২৯০)

সত্যের স্মরণ

ইবাদতের যাবতীয় নৈতিক,সামাজিক ও আধ্যাত্মিক প্রভাব ও কার্যকারিতার উৎসমূল কেবল একটি বিষয়ের মধ্যে নিহিত। আর তা ‘পরম সত্যের স্মরণ’এবং সত্য ব্যতীত অন্য সব কিছু ভুলে যাওয়া ও স্মরণ (যিকর) না করা। পবিত্র কোরআনে ইবাদতের পরিশুদ্ধকারী প্রভাব ও এর আধ্যাত্মিক ক্ষমতা ও শক্তির প্রতি এক জায়গায় ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে : “নামায মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে।” এ গ্রন্থের আরেক জায়গায় বলা হয়েছে : “যাতে করে আমার স্মরণে থাক সেজন্য নামায কায়েম কর।” এ সব আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে,যে ব্যক্তি নামায পড়বে এবং মহান আল্লাহর ধ্যানে থাকবে তাকে সব সময় স্মরণ রাখতে হবে যে,একজন সর্বজ্ঞ ও সর্বদ্রষ্টা সত্তা তাকে পর্যবেক্ষণ করছেন এবং সে যেন ভুলে না যায় যে,সে একজন দাস (বান্দা)।

মহান আল্লাহর স্মরণ ও ধ্যানই হচ্ছে ইবাদতের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এ স্মরণ ও ধ্যান অন্তঃকরণকে স্বচ্ছ,নির্মল ও উজ্জ্বল করে এবং মহান আল্লাহর তাজাল্লী গ্রহণের জন্য উপযুক্ত করে। পরম সত্যের স্মরণ যা ইবাদতের রূহ অর্থাৎ মূল সারবত্তা ও নির্যাসস্বরূপ এতদপ্রসঙ্গে হযরত আলী (আ.) বলেছেন,

“মহান আল্লাহ্ অন্তঃকরণসমূহের স্বচ্ছতাস্বরূপ তাঁর যিকিরের বিধান দিয়েছেন;তাই অন্তঃকরণসমূহ বধিরতার পর এ স্বচ্ছতা অর্থাৎ যিকিরের দ্বারা শ্রবণ করে,অন্ধত্বের পর তদ্বারা দর্শন ও অবলোকন করে এবং অবাধ্যতা ও পাপাচারের পর তদ্বারা (মহান আল্লাহর প্রতি) অনুগত হয়। সর্বদা এমনই ছিল ও আছে যে,মহান আল্লাহ্ প্রতিটি যুগে ও যে সময়গুলোতে কোন নবী জনগণের মাঝে বিদ্যমান থাকতেন না সে সময়গুলোতেও এমন সব বান্দা ছিল এবং আছে মহান আল্লাহ্ যাদের চিন্তা-চেতনায় নিভৃতে-গোপনে তাদের সাথে আলাপ করেছেন এবং তাদের বিবেক ও বুদ্ধিবৃত্তির মাধ্যমে তাদের সাথে কথা বলেছেন। (নাহজুল বালাগাহ্,ভাষণ নং ২২০)

হযরত আলী (আ.)-এর এ সব বাণীতে পরম সত্যের যিকিরের অদ্ভূত বিশেষত্ব ও অন্তঃকরণসমূহের ওপর এর আশ্চর্যজনক প্রভাবের কথা,এমনকি অন্তঃকরণসমূহ যে যিকিরের মাধ্যমে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ইলহাম (ঐশী অনুপ্রেরণা) লাভ এবং তাঁর সাথে কথোপকথনের যোগ্যতা অর্জন করে সে বিষয়টিও উল্লিখিত হয়েছে।

আধ্যাত্মিক মাকাম (মর্যাদা) ও অবস্থাসমূহ

যে সব অবস্থা,মাকাম ও কারামত ইবাদতের আলোকে আধ্যাত্মিক সাধকগণের জন্য প্রকাশ পায় সেগুলো এ ভাষণে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যেমন তিনি বলেছেন, “ফেরেশতাগণ তাদেরকে বরণ করে নিয়েছে। তাদের ওপর প্রশান্তি অবতীর্ণ হয়েছে। আকাশের দরজাসমূহ তাদের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে। মহান আল্লাহর অশেষ ঐশ্বরিক কৃপার স্থল তাদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। মহান আল্লাহ্ তাদের মাকাম,পর্যায় ও মর্যাদা যা তারা ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে অর্জন করেছে তা দেখেছেন এবং তাদের কর্মকে পছন্দ করেছেন এবং তাদের অবস্থান ও মর্যাদার প্রশংসা করেছেন। তাই তারা যখন মহান আল্লাহকে ডাকে (তাঁর কাছে প্রার্থনা করে) তখন তারা ঐশ্বরিক ক্ষমার সুঘ্রাণ পেয়ে থাকে এবং পাপের অন্ধকারাচ্ছন্ন পর্দাগুলো বিদূরিত হওয়ার বিষয়টিও অনুভব করে।”

মহান আল্লাহর ইবাদতে নিবেদিত আধ্যাত্মিক সাধকদের রাত

নাহজুল বালাগার দৃষ্টিতে ইবাদত-বন্দেগীর জগৎ সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জগৎ। ইবাদতের জগৎ নির্মল আনন্দে ভরপুর। সে আনন্দ এমনই যার সাথে ত্রিমাত্রিক বস্তুগত পার্থিব আনন্দের মোটেও তুলনা করা যায় না। ইবাদতের জগৎ গতি,আন্দোলন,কর্মচাঞ্চল্য,পরিক্রমণ ও পরিভ্রমণে পরিপূর্ণ। তবে সে সফর ও পরিক্রমণ মিশর,ইরাক ও শাম অথবা পৃথিবীর অন্য যে কোন শহরে গিয়ে সমাপ্ত হয় না-তা এমন এক শহরে গিয়ে সমাপ্ত হয় যার কোন নাম নেই। ইবাদতের জগতে দিবা-রাত্রি নেই। কারণ এ জগৎ আলোর জগৎ,এ জগতের সর্বত্র ঔজ্জ্বল্য বিদ্যমান,এ জগতের কোথাও আঁধার,অস্বচ্ছতা,দুঃখ-কষ্ট ও মলিনতা নেই। এখানে আছে শুধু স্বচ্ছতা,আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা। যে ব্যক্তি এ জগতে পদার্পণ করে এ জগতের প্রাণসঞ্জীবনী মৃদুমন্দ সমীরণ যার ওপর স্নেহের পরশ বুলিয়ে দেয় সে কতই না সৌভাগ্যবান! যে এ জগতে পদার্পণ করে সে মোটেও মাথা ঘামায় না ও তোয়াক্কা করে না যে,সে এ দুনিয়ায় রঙ্গীন গিলাফবিশিষ্ট নরম বালিশের ওপরে মাথা রেখে ঘুমায় নাকি শক্ত ইটের ওপরে। হযরত আলী (আ.) বলেছেন,

“ঐ ব্যক্তি কতই না সৌভাগ্যবান যে তার নিজ প্রভুর উদ্দেশ্যে ফরযসমূহ আঞ্জাম দিয়েছে [মহান আল্লাহ্ যার সঙ্গী,হামদ (গুণকীর্তন) ও সূরা ইখলাস পাঠ যার কাজ],যাঁতাকলে যেভাবে শস্যদানা পিষ্ট করা হয়া তদ্রূপ সে তার পার্শ্বদেশ দিয়ে সকল দুঃখ-কষ্ট ও যন্ত্রণাকে পিষে ফেলে;সে রাতের বেলা তার নরম আরামপ্রদ নিদ্রাস্থল ত্যাগ করে,এমনকি যখন নিদ্রা তার ওপর প্রবল হয় তখন সে যমীনকে কার্পেট (বিছানা) এবং হাতের তালুকে বালিশ করে নেয়;সে এমন এক গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত কিয়ামত দিবসের ভীতি যাদের নয়নগুলোকে জাগ্রত ও নিদ্রাহীন করে রেখেছে এবং যারা তাদের দেহকে শয়নস্থল থেকে উঠিয়ে এনেছে। তাদের ঠোঁট তাদের মহাপ্রভুর স্মরণে ধীরে ধীরে নড়াচড়া করে,তাদের পাপের কালো মেঘগুলো তাদের সার্বক্ষণিক ক্ষমা প্রার্থনার কারণে বিদূরিত হয়ে যায়;এরাই হচ্ছে মহান আল্লাহর দল;জেনে রাখ যে,নিশ্চয়ই আল্লাহর দলই সফলকাম।”

নাহজুল বালাগায় ইবাদত ও ইবাদতকারীদের প্রকৃতি ও স্বরূপ অঙ্কন

ইবাদত সংক্রান্ত নাহজুল বালাগার দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা করা হয়েছে। যার ফলে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে,নাহজুল বালাগার দৃষ্টিতে ইবাদত-বন্দেগী নিছক কতগুলো শুষ্ক ও নিষ্প্রাণ দৈহিক ক্রিয়া সম্পাদন করা নয়। শারীরিক কাজগুলো হচ্ছে ইবাদত-বন্দেগীর বাহ্যিক খোলস বা আবরণ;কিন্তু ইবাদতের রূহ (প্রাণ) এবং এর প্রকৃত অর্থ ও তাৎপর্য সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। শারীরিক ক্রিয়া ও কার্যকলাপগুলো তখনই জীবিত,প্রাণবন্ত এবং ইবাদত হওয়ার যোগ্য হবে যখন এগুলোর সাথে গভীর আধ্যাত্মিক তাৎপর্য সংযুক্ত হবে। প্রকৃত ইবাদত হচ্ছে ত্রিমাত্রিক বস্তুজগৎ থেকে বের হয়ে অন্য এক জগতে (আধ্যাত্মিক অজড় জগৎ) পদার্পণ যা গতিময়তা,প্রাণবন্ততা,আত্মিক-আধ্যাত্মিক বিষয়াদি ও বিশেষ ধরনের অনাবিল আনন্দে ভরপুর।

নাহজুল বালাগায় ইবাদত-বন্দেগী ও আধ্যাত্মিক পরিক্রমণকারীদের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রচুর বিষয় রয়েছে। অন্যভাবে বলতে গেলে এ গ্রন্থে ইবাদত ও ইবাদতকারীদের প্রকৃত স্বরূপ চিত্রিত হয়েছে। কখনো কখনো আবেদ ও সালিক (আধ্যাত্মিক পরিব্রাজক ও সফরকারী)-এর স্বরূপ ও অবয়ব বিনিদ্র রজনী যাপন,ভয়ভীতি,আকাঙ্ক্ষা-উদ্দীপনা ও আনন্দ,অনুপ্রেরণা,ক্রন্দন ও অশ্রপাত এবং পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করার দৃষ্টিকোণ থেকে চিত্রিত ও অঙ্কিত হয়েছে। কখনো কখনো হৃদয়ের ওপর আপতিত বিষয়াদি এবং গায়েবী আনুকূল্য ও অনুগ্রহ প্রদর্শনসমূহ যেগুলো ইবাদত,গভীর পর্যবেক্ষণ ও প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদের আলোকে তাদের (আবেদ ও সালিক) অর্জিত হয় সেগুলোও বর্ণিত হয়েছে। কখনো কখনো পাপ দূরীকরণ ও পাপের নিকষ কালো চিহ্ন ও প্রভাব বিলুপ্তিকরণ ও মুছে ফেলার দৃষ্টিকোণ থেকেও ইবাদত-বন্দেগীর প্রভাব ও কার্যকারিতা আলোচনার বিষয়বস্তু হয়েছে। কখনো কখনো কতিপয় নৈতিক ব্যাধি এবং মানসিক বিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে ইবাদতের প্রভাব ও কার্যকারিতার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। কখনো কখনো আবেদ,পার্থিব বিষয়াদি বর্জনকারী সাধক ও আধ্যাত্মিক পথ পরিক্রমণকারীদের নির্মল,নিঃখাদ ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী আনন্দ ও সৌন্দর্যও উল্লিখিত হয়েছে।

বিনিদ্র রজনী যাপন

“রাতগুলোতে তারা নিজেদের পা ইবাদতের জন্য বিছিয়ে দাঁড়ায়,পবিত্র কোরআনের আয়াতগুলো প্রশান্তভাবে তেলাওয়াত করতে থাকে,ঐ সব আয়াত নিচুস্বরে পাঠ এবং ঐগুলোর অর্থ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে করতে হৃদয়ে আধ্যাত্মিক দুঃখ ও বিমর্ষতার উদ্ভব হয়। আর তাদের দুঃখ-বেদনার উপশমও ঠিক এভাবেই প্রকাশ করে। তাই যখন তারা পবিত্র কোরআনের ভাষায় যা কিছু শোনে যেন তারা স্বচক্ষে সেগুলো প্রত্যক্ষ করে। যখনই তারা রহমতের কোন আয়াতে উপনীত হয় তখন তারা লোভবশত সেখানে সেই আয়াতের দিকে তাদের অন্তঃকরণকে ধাবিত করে,তাদের হৃদয় তীব্র আকাঙ্ক্ষা ও উৎসাহ সহকারে ঐ আয়াতের প্রতি নিবিষ্ট হয় এবং তারা ভাবতে থাকে যে,তা তাদের নয়নমণি;আর যখন তারা পারলৌকিক শাস্তির ভয় প্রদর্শনকারী কোন আয়াতে উপনীত হয় তখন তাদের অন্তঃকরণের কর্ণসমূহ গভীর মনোযোগ সহকারে তা শ্রবণ করে এবং তারা তখন ভাবতে থাকে যে,জাহান্নামের লেলীহান অগ্নিশিখা উঁচু-নিচু হওয়ার শব্দ তাদের কর্ণকুহরে পৌঁছে যাচ্ছে;তারা ইবাদতের মধ্যে তাদের কোমর ঋজু করে;তারা নিজেদের কপাল,হাতের তালু,জানু (হাটু) এবং পা মাটির ওপর বিছিয়ে দেয় এবং মহান আল্লাহর কাছে (দোযখের আগুন থেকে) নিজেদের মুক্তি প্রার্থনা করে। এ সব ব্যক্তি যারা এ ধরনের বিনিদ্র রজনী যাপন করে এবং যাদের আত্মা এত পরিমাণ অন্য জগতের সাথে যুক্ত,তারা দিনের বেলায় থাকে ধৈর্যশীল,জ্ঞানী,সৎ ও মুত্তাকী (অর্থাৎ তারা সামাজিক এবং সমাজে বিচরণ করে;সমাজের সাথে থাকে এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে।)” (নাহজুল বালাগাহ্,ভাষণ নং ১৯১)

মানব হৃদয়ের ওপর যে সব বিষয়ের প্রভাব পড়ে সেগুলো

“সে তার বিবেক-বুদ্ধিকে জাগ্রত এবং প্রবৃত্তির মৃত্যু ঘটায়। যার ফলে তার স্থূলতা ও মেদ দূরীভূত হয়ে দেহ মেদহীন ও কৃশ হয়ে যায়;আর চিত্তের কাঠিন্য ও কর্কশতা কোমলতায় রূপান্তরিত হয়। তার অন্তরের ওপর সুতীব্র জ্যোতির্ময় আলোর প্রভা আপতিত হয় এবং তা তার সম্মুখে চলার পথকে আলোকিত করে দেয় এবং তাকে সে পথে পরিক্রমণ করার জন্য গতিশীল ও সচল করে। তাকে এক মঞ্জিল থেকে আরেক মঞ্জিলে নিয়ে যায়;অবশেষে তাকে নিরাপদ ও শান্তির আবাসস্থলের দোর গোড়ায় পৌঁছে দেয় যেখানে তার দেহ সুস্থির হয় এবং তার পদদ্বয় স্থিতি লাভ করে (সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে।) আর এটি এ কারণে সম্ভব হয় যে,সে তার হৃদয়কে কাজে লাগিয়েছে এবং মহান প্রভু আল্লাহকে সন্তুষ্ট করেছে।” (নাহজুল বালাগাহ্,ভাষণ নং ২১৮)

এ সব বাণীতে ঠিক যেমনটি আমরা প্রত্যক্ষ করছি ঠিক তদ্রূপ ইমাম আলী (আ.) অন্য এক জীবন সম্পর্কে কথা বলেছেন যা ‘হায়াতে আকল’অর্থাৎ খাঁটি অজড়-অধ্যাত্ম জীবন বলে অভিহিত করা হয়েছে। ‘জিহাদে আকবার’(প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম) এবং ‘নাফসে আম্মারাহ্’(কুপ্ররোচনাদানকারী প্রবৃত্তি)-এর মৃত্যু ঘটানো সংক্রান্ত বর্ণনাও রয়েছে এ সব বাণীতে। এ সব বাণীতে দেহ ও আত্মার আধ্যাত্মিক সাধনা এবং ঐ বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গের কথাও এসেছে যা মুজাহাদাহ্ অর্থাৎ প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের ফলে আধ্যাত্মিক সাধকের অন্তরে পরিদৃষ্ট হয় এবং তার অন্ত র্জগতকে আলোকোদ্ভাসিত করে তোলে। ঐ সব আধ্যাত্মিক মঞ্জিল ও পর্যায়ের কথাও এসেছে যেগুলো অত্যুৎসাহী সালিকের আত্মা ধীরে ধীরে অতিক্রম করে এবং অবশেষে মঞ্জিলে মাকসূদে পৌঁছে যায় যা হচ্ছে মানুষের আধ্যাত্মিক সফর ও অসীম অধ্যাত্ম জগতের পানে ঊর্ধ্বগমন।

“হে মানুষ! নিশ্চয়ই তুমি তোমার প্রভুর দিকে আগমন করার এমন এক প্রচেষ্টায় রত যার ফলে তুমি তাঁর সাক্ষাৎ করবে।” (সূরা ইনশিকাক : ৮৪)

চিত্তের প্রশান্তি ও নিরুদ্বিগ্নতার কথাও এসেছে যা অবশেষে অশান্ত,অস্থির ও ধারণক্ষমতাসম্পন্ন মানব হৃদয় প্রাপ্ত হয় :

“জেনে রাখ! কেবল মহান আল্লাহর স্মরণের দ্বারাই অন্তঃকরণসমূহ স্থিতিশীল হয় ও প্রশান্তি লাভ করে।” (সূরা রা’দ : ১৩)

২২৮ নং খুতবায় অন্তঃকরণের জীবনের প্রতি এ শ্রেণীর (আধ্যাত্মিক সাধকগণ) মনোযোগ ও দৃষ্টি এভাবে বর্ণিত হয়েছে :

“দুনিয়াদার অর্থাৎ পার্থিব জীবন ও জগতের প্রতি অনুরক্তগণ দৈহিক মৃত্যুকে বড় করে দেখে। আর এরা (আধ্যাত্মিক ব্যক্তিগণ) এ পার্থিব জগতে জীবিতদের হৃদয়ের মৃত্যুর ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপের প্রবক্তা এবং একে অত্যন্ত বড় বলে মনে করে।”

যে সব আকর্ষণ এবং আধ্যাত্মিক সিদ্ধি লাভের অনুভূতি উপযুক্ত আত্মাগুলোকে হরণ করে এবং অধ্যাত্মিক জগতের দিকে নিয়ে যায় সে ব্যাপারে এরূপ বর্ণনা এসেছে :

“দুনিয়া ও দুনয়িাদারদের সাথে তারা একত্রে বসবাস করেও তাদের দেহের আত্মা সর্বোচ্চ স্থানসমূহের দিকে নিবদ্ধ।” (খুতবা : ১৯১)

“যদি তাদের জন্য মৃত্যুর চূড়ান্ত মুহূর্ত নির্ধারিত ও অবধারিত করা না হতো তাহলে মহান আল্লাহর কাছ থেকে পুণ্য লাভের আশা ও শাস্তির ভয়ে তাদের আত্মা চোখ বন্ধ ও খোলা পরিমাণ সময়ও তাদের দেহে স্থির থাকত না ও অবস্থান করত না।” (খুতবা : ১৯১)

“সে মহান আল্লাহর জন্য নিজেকে ও তার নিজ আমলকে পরিশুদ্ধ করেছে;আর মহান আল্লাহ্ তাঁর বিশেষ দয়া ও অনুগ্রহের দ্বারা তাকেও একান্ত আপন ও নিজের করে নিয়েছেন।” (খুতবা : ৮৫)

চিত্তের পরিশুদ্ধকরণ (তাহযীবে নাফস) এবং মহান আল্লাহর দাসত্ব ও ইবাদত করার মাধ্যমে ঊর্ধ্বজগৎ থেকে যে সব আরোপিত তত্ত্বজ্ঞান ও আধ্যাত্মিক ঔজ্জ্বল্য আধ্যাত্মিক পথ পরিক্রমণকারীদের অন্তরের ওপর প্রতিফলিত হয় এবং যে নিশ্চিত বিশ্বাস তাদের অর্জিত হয় সেগুলো সম্পর্কে তিনি বলেছেন,

“যে তত্ত্বজ্ঞান প্রকৃত অন্তর্দৃষ্টির ওপর প্রতিষ্ঠিত সেই জ্ঞান তাদের অন্তঃকরণসমূহের ওপর আপতিত হয়েছে;তারা নিশ্চিত বিশ্বাসের সারবত্তা অনুভব করেছে;যা কিছু বিলাসবহুল জীবনযাপনকারীদের জন্য কষ্টকর ও কঠিন তা তারা নিজেদের জন্য সহজসাধ্য করে নিয়েছে;আর যে বিষয়কে মূর্খরা ভয় করে তার সাথে তারা ঘনিষ্ঠ ও অন্তরঙ্গ হয়ে গেছে।”

পাপ-বিনাশ

ইসলামী শিক্ষা ও নীতিমালার আলোকে মানুষের অন্তরের ওপর প্রতিটি পাপ স্থায়ী নেতিবাচক এবং বিষণ্ণতা ও পঙ্কিলতা আনয়নকারী প্রভাব রেখে যায়। এর ফলে ভালো ও সৎ কাজের প্রতি পাপী মানুষের ঝোঁক কমে যায় এবং পাপ কাজের প্রতি তার আগ্রহ ও আসক্তি বেড়ে যায়।

ইবাদত-বন্দেগী ও মহান আল্লাহর স্মরণ মানুষের ধর্মীয় বিবেককে জাগ্রত ও সুশিক্ষিত করে তোলে। সৎ কাজের প্রতি তার আগ্রহ ও ঝোঁক বৃদ্ধি করে এবং মন্দ কাজ ও পাপের প্রতি ঝোঁক ও আগ্রহ হ্রাস করে দেয়। অর্থাৎ পাপ থেকে উদ্ভূত মলিনতা ও পঙ্কিলতা অপসারিত হয়ে যায় এবং তা কল্যাণকর কাজের প্রতি ঝোঁক ও আগ্রহের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়।

নাহজুল বালাগায় এমন একটি ভাষণ আছে যাতে নামায,যাকাত ও আমানত রক্ষা করার ব্যাপারে আলোচনা করা হয়েছে। নামায সংক্রান্ত সদুপদেশ ও গুরুত্বারোপ করার পর ইমাম আলী (আ.) বলেছেন,

“গাছের পাতা যেমন ঝরে পড়ে নামায ঠিক তদ্রূপ পাপগুলোকে ঝরিয়ে দেয় এবং পাপের রজ্জু ও বন্ধন থেকে মানুষকে মুক্তি দেয়। মহানবী (সা.) নামাযকে উষ্ণ পানির প্রস্রবণের সাথে তুলনা করেছেন যা কোন লোকের গৃহের নিকটেই রয়েছে এবং সে প্রতিদিন তাতে পাঁচ বার নিজেকে ধৌত করে। এভাবে ধোয়ার ফলে দেহের ওপর কি ময়লা-আবর্জনা থাকতে পারে?” (খুতবা : ১৯৭)

চারিত্রিক-নৈতিক রোগমুক্তি

অবাধ্যতা,বিরুদ্ধাচরণ,জুলুম ও অহংকারের মতো কতিপয় নৈতিক দোষের দিকে ইঙ্গিত করার পর ১৯৬ নং খুতবায় হযরত আলী (আ.) বলেছেন,

“যেহেতু মানুষ এ সব চারিত্রিক দোষ ও মানসিক ব্যাধি কবলিত সেহেতু মহান আল্লাহ্ নামায,যাকাত ও নির্দিষ্ট দিনগুলোতে রোযা পালনের মাধ্যমে মুমিন বান্দাদেরকে এ সব বিপদ ও দুর্যোগ থেকে রক্ষা করেছেন। এ সব ইবাদত মানুষের হাত-পাকে পাপ থেকে বিরত রাখে,চোখগুলোকে অবনত ও বিনম্র করে,প্রবৃত্তিকে বশীভূত ও হৃদয়কে বিনয়ী করে এবং নাসিকার বায়ুকে অপসারিত করে (অর্থাৎ তার গর্ব ও অহংকার বিদূরিত করে।)

অন্তরঙ্গতা ও আনন্দ

“হে আল্লাহ্! তুমি তোমার বন্ধুদের সবচেয়ে অন্তরঙ্গ ও ঘনিষ্ঠ এবং তোমার ওপর নির্ভরকারী ও ভরসাকারীদের জন্য যথেষ্ট হওয়ার ক্ষেত্রে সকলের চেয়ে বেশি প্রস্তুত। তুমি তাদের অন্তরের অন্তস্তলে দেখ এবং তুমি তাদের হৃদয়ের অভ্যন্তরভাগ সম্পর্কেও জ্ঞাত। তাদের বিচক্ষণতা ও জ্ঞানের পরিমাণ এবং দৃষ্টিনিবদ্ধ স্থলও তোমার জানা। তাই তোমার কাছে তাদের গোপন রহস্যগুলো প্রকাশিত এবং তোমার প্রতি তাদের হৃদয়সমূহ বিচ্ছেদ ব্যথায় অস্থির ও কাতর;যখন একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতা তাদের ভয়ভীতির উদ্রেক করে তখন তোমার স্মরণ তাদের কাছে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ও অন্তরঙ্গ হয়ে যায়। আর তাদের ওপর কঠিন বিপদাপদ আপতিত হলে তারা তোমার কাছেই আশ্রয় নেয়।”

“নিশ্চয়ই মহান আল্লাহর যিকিরের জন্য এমন সব উপযুক্ত ব্যক্তি আছে যারা পার্থিব নেয়ামতসমূহের স্থলে এ যিকিরকেই বেছে নিয়েছেন।” (খুতবা : ২২০)

১৪৮ নং খুতবায় হযরত আলী (আ.) ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। এ ভাষণের শেষের দিকে তিনি শেষ যুগের একদল লোকের কথা উল্লেখ করেছেন যাদের মধ্যে সাহস,প্রজ্ঞা,বুদ্ধিমত্তা ও ইবাদত-বন্দেগীর সমাবেশ ঘটেছে। তিনি বলেছেন,

“অতঃপর কামারের হাতে তীর যেমন তীক্ষ্ণ,ধারালো ও চকচকে হয় ঠিক তদ্রূপ একদল ব্যক্তির (আবেদ ও সালিক ব্যক্তিগণ) অন্তরের মরিচা ও কালিমা দূর করে তা চকচকে ও তীক্ষ্ণ করা হয়। পবিত্র কোরআনের মাধ্যমে তাদের অন্তর চক্ষুর সামনে থেকে পর্দা ও অন্তরায়সমূহ অপসারিত করা হয় এবং পবিত্র কোরআনের অন্তর্নিহিত অর্থ ও তাৎপর্যের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ তাদের কর্ণকুহরে প্রতিফলিত হয় ও পৌঁছে যায়। যার ফলে তারা প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় প্রজ্ঞা ও সূক্ষ্ম তত্ত্বজ্ঞানের পানপাত্র থেকে প্রজ্ঞা ও তত্ত্বজ্ঞানের শরবত (অমিয় সূধা) পান করতে থাকে।”

আলোচ্য প্রবন্ধটি শহীদ আয়াতুল্লাহ্ মুর্তাজা মুতাহ্হারী প্রণীত ‘সেইরী দার নাহজুল বালাগাহ্’গ্রন্থের তৃতীয় অধ্যায় ‘সুলূক ও ইবাদত’(ইবাদত ও আধ্যাত্মিক পরিক্রমণ)-এর অনুবাদ।

(সূত্র :জ্যোতি বর্ষ ২ সংখ্যা ৩)

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনা : একটি ...
Protest einer Antikriegsgruppe gegen Luftangriff Amerikas auf ein Krankenhaus
খলিফা নির্বাচনের পদ্ধতি
‘বাতিলের মুকাবিলায় ঐক্যই ...
অর্থসহ মাহে রমজানের ৩০ রোজার দোয়া
কোরআন ও চিকিৎসা বিজ্ঞান
শিয়াদের মৌলিক বিশ্বাস (পর্ব-১)
সূরা ইউনুস;(১৭তম পর্ব)
মহানবী (স.) হতে বর্ণিত ৪০টি হাদীস (২)
পরকালের জন্য প্রস্তুতি এবং ...

 
user comment