বাঙ্গালী
Friday 29th of March 2024
0
نفر 0

কোরআন ও চিকিৎসা বিজ্ঞান

ইসলাম ধর্মে জ্ঞানার্জনের উপর ব্যাপক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার ব্যাপারে নানা দিক নির্দেশনা রয়েছে। চিকিৎসা বিষয়ে কোরআনে উল্লেখিত বিষয়াদির ব্যাপক গুরুত্বের কারণে এ পর্যন্ত এ ইস্যুতে বহু সেমিনার ও সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। ইরানের রাজধানী তেহরানে গত ১৮ই ফেব্রুয়ারি ‘কোরআন ও চিকিৎসা বিজ্ঞান’ শীর্ষক একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই সেমিনারে কোরআন ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গী তুলে ধরেছেন।
জ্ঞানার্জন বিশেষকরে চিকিৎসা শাস্ত্রের উপর ইসলাম ধর্ম গুরুত্বারোপ করার কারণে মুসলমানরা ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকেই এ ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। এর ফলে মুসলমানরা চিকিৎসা বিজ্ঞানে ব্যাপক অবদান রাখতে সক্ষম হন। আবু আলী সিনা, জাকারিয়া ও ইবনে রূশদসহ আরও বহু মুসলিম মনীষী চিকিৎসা বিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। তারা চিকিৎসার নতুন নতুন পদ্ধতি আবিস্কার করেছেন। ইসলামের প্রথম শতাব্দিতেই মুসলিম বিশ্বের নানা প্রান্তে বহু সমৃদ্ধ হাসপাতাল গড়ে ওঠেছিল। এসব হাসপাতালে বিশেষ বিশেষ রোগের চিকিৎসার জন্য আলাদা আলাদা ইউনিটও ছিল। ফ্রান্সের বিশিষ্ট লেখক ও চিন্তাবিদ পিয়েরে রুসো তার বিজ্ঞানের ইতিহাস বইয়ে চিকিৎসা শাস্ত্রে মুসলমানদের অগ্রগতি সম্পর্কে লিখেছেন, একবার স্পেনের এক বাদশা রোগাক্রান্ত হয়ে পড়লে উপায়ান্তর না দেখে কর্ডোভা শহরে মুসলমানদের কাছে চিকিৎসা নিতে গিয়েছিলেন।
চিকিৎসা শাস্ত্র সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের দিকনির্দেশনা নিয়ে আলোচনার আগে এটা বলে রাখছি যে, কোরআনে চিকিৎসা শাস্ত্র সম্পর্কে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দিকনির্দেশনা থাকলেও তা চিকিৎসা শাস্ত্রের বই হিসেবে বিবেচিত হয়না। আল্লাহতায়ালা নিজেই বলেছেন, কোরআন হচ্ছে মানুষের জন্য সরল ও সঠিক পথের নির্দেশক এবং তা পারলৌকিক ও পার্থিব জীবনের কল্যাণ নিশ্চিতকারী গ্রন্থ। কোরআনে চিকিৎসা শাস্ত্রের কথা উল্লেখ করার অর্থ হলো মানুষের কল্যাণে চিকিৎসা বিজ্ঞানের গুরুত্বকে তুলে ধরা। ‘কোরআন ও চিকিৎসা বিজ্ঞান’ শীর্ষক সেমিনারের সচিব মোহাম্মদ আব্বাসি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, কোরআনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অলৌকিক দিকগুলোর একটি হচ্ছে চিকিৎসা বিজ্ঞান, যা বিশ্বের গবেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আমরা যদি মনোযোগের সাথে কোরআনের আয়াতগুলো লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাই, আসমানী এ গ্রন্থে মানুষের দৈহিক ও মানসিক রোগ নিরাময়ের বিষয়টি একইসঙ্গে রয়েছে। সুরা রা’দের ২৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, জেনে রাখুন, কেবলমাত্র আল্লাহকে স্মরণের মাধ্যমেই আত্মা প্রশান্তি লাভ করে।
অন্যদিকে, আল্লাহর কাছ থেকে দূরে সরে যাবার কারণে মানুষ দুরবস্থায় পতিত হয় বলেও এই মহাগ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া, পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে সংকট ও সমস্যার মুহুর্তে ধৈর্য্য ধারণ করতে বলা হয়েছে। ধৈর্য্য ধারণের পাশাপাশি আল্লাহর স্মরণ মানুষকে আত্মিক প্রশান্তি দেয়। পাশাপাশি এর ফলে মানুষের কঠিন পরিস্থিতি ও সমস্যা মোকাবেলার শক্তিও বৃদ্ধি পায়। ইসলাম মুসলমানদেরকে এ শিক্ষা দেয় যে, আনন্দ এবং দু:খ-কষ্ট উভয়ই ক্ষণস্থায়ী। কাজেই মানুষকে যে কোন কঠিন পরিস্থিতির জন্যও সব সময় প্রস্তুত থাকতে হবে এবং দুঃখ-কষ্টকে আল্লাহর পক্ষ থেকে এক ধরনের পরীক্ষা হিসেবে গণ্য করতে হবে। আল্লাহতায়ালা নানা ভাবে মানুষকে পরীক্ষা করে থাকেন। আর এর ফলে ঈমান আরও দৃঢ় হয়।
পবিত্র কোরআনে এমন সব দিক-নির্দেশনা রয়েছে, যা মানসিক প্রশান্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি বিভিন্ন সমস্যা থেকে মানুষকে দূরে রাখে। যেমন ইসলামে তরুণদের বিয়ে এবং পরিবার গঠনের ওপর অপরিসীম গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সুরা রূমের ২১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য হতে তোমাদের সঙ্গিনীদের সৃষ্টি করেছেন,যাতে তোমরা তাদের নিকট শান্তি পাও এবং তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও সহানুভূতি সৃষ্টি করেছেন। চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য এতে নিদর্শন রয়েছে।’
ইসলাম ধর্ম পারিবাবিক ও আত্মীয়তার বন্ধন সুদৃঢ় রাখার উপর ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েছে। সকল আত্মীয়-স্বজন বিশেষ করে পিতা-মাতার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে বারবার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পারস্পরিক বন্ধন ও সুসম্পর্ক, মানুষকে মানসিক দিক থেকে সুস্থ্য ও ভারসাম্যপূর্ণ থাকতে সহায়তা করে। মুসলমানদেরকে পবিত্র কোরআন অধ্যয়ন, নামাজ আদায়, দোয়া করা এবং অন্যান্য এবাদতের মাধ্যমে নিজের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করতে বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, এর ফলে মানসিক প্রশান্তি নিশ্চিত হবে। মানুষ যদি মনপ্রাণ দিয়ে আন্তরিকতার সাথে তার সৃষ্টিকর্তাকে ডাকে তাহলে অবশ্যই সে তার ফল পাবে। আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে বলেছেন, আমাকে ডাক,আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব।
পবিত্র কোরআন, মানষিক ও আত্মিক সমস্যার সমাধানসূত্রের পাশাপাশি দেহের নানা রোগ নিরাময়েরও পথ বাতলে দিয়েছে। ইসলাম ধর্ম রোগ প্রতিরোধের ওপরই সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে। কোরআনের বিভিন্ন আয়াত এবং হাদিসে এমন সব দিকনির্দেশনা রয়েছে,যা রোগ প্রতিরোধের জন্য অত্যন্ত কার্যকর। যেমন বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, ক্ষুধার্ত না হলে খেতে বসনা এবং পেট পরিপূর্ণ হবার আগেই খাওয়া শেষ কর। রাসূল (সাঃ) ও ইমামগণ এমন সব খাদ্যদ্রব্যের নাম উল্লেখ করেছেন,যা ব্যাথা উপশমসহ নানা রোগ থেকে মানুষকে মুক্ত রাখে। একই সাথে কোরআনে অনেক খাদ্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকতেও বলা হয়েছে। মানুষের মন-মানষিকতার ওপর খাদ্যের প্রভাবের কথাও কোরআনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। সূরা বাকারার ১৬৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, হে মানব-জাতি! পৃথিবীতে যা কিছু বৈধ ও পবিত্র খাদ্য আছে, তা হতে তোমরা খাও এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করোনা। নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু । মহাগ্রন্থ আল কোরআনে কিছু কিছু খাদ্য ও পানীয়কে হারাম বা অবৈধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে।এসব খাদ্য ও পাণীয় মানুষের শরীর ও মনের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। এর মধ্যে মদ, শুকরের গুশত ও মৃত প্রাণীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
কোরআনে রোগ নিরাময়কারী কিছু খাদ্যের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে,যা আল্লাহতায়ালার শক্তি ও সামর্থ্যের বহিঃপ্রকাশও বটে। এছাড়া পবিত্র কোরআনে কিছু ওষুধের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনের একটি সূরার নাম নহল বা মৌমাছি। ফুলের মধু আহরণ ও চাক তৈরীসহ মৌমাছির বিভিন্ন কর্মপ্রণালী সম্পর্কে বর্ণনা তুলে ধরে সূরা নহলের ৬৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,” ওদের উদর হতে বিবিধ বর্ণ-বিশিষ্ট পানীয় নির্গত হয়ে থাকে, এতে মানুষের জন্য ব্যাধির প্রতিকার আছে।” এই আয়াতে মধুর গুণাবলী সম্পর্কে বলা হয়েছে।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন, রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে মধুর মতো এত বেশী কার্যকর আর কোন উপাদান নেই। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানেও এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, মধুর নানা বিশেষত্ব রয়েছে এবং তা রোগ নিরাময়ে ব্যাপক কার্যকর।
পবিত্র কোরআনে চিকিৎসা বিজ্ঞানের আরেকটি দিক সম্পর্কে স্পষ্ট ভাবে বলা হয়েছে। শুক্রানু থেকে ভ্রুণ গঠন ও ভ্রুণের বেড়ে ওঠার যে পর্যায়গুলো কোরআনে বর্ণনা করা হয়েছে,তা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ। চৌদ্দ’শ বছরেরও বেশি সময় আগে যখন তৎকালীন সমাজে এ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারনা বিরাজ করছিল, তখন পবিত্র কোরআন স্পষ্ট ভাবেই ঘোষণা করে যে, শুক্রাণু জরায়ুতে স্থাপিত হয়। পবিত্র কোরাণে ভ্রুণের পূর্ণতালাভের প্রক্রিয়া সম্পর্কে বর্ণনা দেয়া হয়েছে।সূরা মো’মেনুনের ১২ থেকে ১৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “নিশ্চয় আমি মানুষকে মৃত্তিকার উপাদান হতে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর আমি তাকে শুক্রবিন্দুরূপে এক নিরাপদ আধারে স্থাপন করি। পরে আমি শুক্রবিন্দুকে জমাট রক্তে পরিণত করি, অত:পর জমাট রক্তকে মাংস পিন্ডে পরিণত করি এবং মাংস পিন্ডকে অস্থি-পঞ্জরে, অত:পর অস্থি-পঞ্জরকে মাংস দ্বারা ঢেকে দেই। অবশেষে আমি তাকে চরম সৃষ্টিতে পরিণত করি, অতএব আল্লাহ মহান,যিনি শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টিকর্তা।”
এছাড়া পবিত্র কোরআনে মানুষের সুস্থতার প্রতি ব্যাপক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রোজার বিধান অন্যতম। মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় রোজা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। মহানবী (সাঃ) বলেছেন, রোজা রাখুন তাহলে সুস্থ্য থাকবেন। চিকিৎসা শাস্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এর নীতিশাস্ত্র। তেহরানে অনুষ্ঠিত কোরআন ও চিকিৎসা শীর্ষক সেমিনারে এ সম্পর্কেও বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে একে অপরের প্রতি ভালোবাসা ও সহমর্মিতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। চিকিৎসা শাস্ত্রের নীতিমালার এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পবিত্র কোরআনের নির্দেশ অনুযায়ী, একজন মুসলিম চিকিৎসক, রোগীর সাথে সুন্দর আচরণ করতে বাধ্য। বলা হয়ে থাকে, ডাক্তারের আচার-ব্যবহার, রোগীকে অর্ধেক সুস্থ্য করে তোলে। কোরআনে সদাচরণের উপর অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সেমিনারে কানাডার বিশ্ববিদ্যালয়- শিক্ষক ও ভ্রুণ বিশেষজ্ঞ কেইথ মোর বলেছেন, গবেষকরা নতুন নতুন বিষয় আবিস্কার করছে আর এটা বুঝতে পারছে যে, কোরআনে এ সম্পর্কে আগেই বলা হয়েছে।

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

বিভিন্ন ফিকাহর দৃষ্টিতে যাকাত
আল-কুরআনের মু’জিযা: একটি ...
সালাতে তারাবী না তাহাজ্জুদ ?
অর্থসহ মাহে রমজানের ৩০ রোজার দোয়া
ইসলাম ধর্ম, চিত্ত বিনোদন ও আনন্দ
জান্নাতুল বাকিতে ওয়াহাবি ...
কোরআনে কারিম তেলাওয়াতের আদব
মহানবীর ওফাত দিবস এবং ইমাম হাসান ...
পবিত্র কোরআনের আলোকে কিয়ামত
ইমাম হাসান (আ.)-এর জন্মদিন

 
user comment