বাঙ্গালী
Thursday 25th of April 2024
0
نفر 0

ইমাম হুসাইন (আ.)-এর জীবনী (৫ম পর্ব)

কোন সমাজের সত্য পথের পথিকরা যখন আলোকিত মানুষের কথা বলেন,ন্যায়-ইনসাফপূর্ণ সমাজের কথা ভাবেন তখন তাঁরা মানবেতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল উত্থানের মাঝে উপমা দেখতে চান। আর তা থেকে শিক্ষা নিতে চান। ন্যায় প্রতিষ্ঠার আন্দোলনগুলোর মাঝে শীর্ষে যে আন্দোলনের অবস্থান তার অন্যতম হলো শহীদদের নেতা ইমাম হুসাইনের আন্দোলন যার বহুমাত্রিক আবেদন এটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ বিপ্লবের ভিত্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ৬১ হিজরীর ১০ মুহররম কারবালা ভূমিতে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র বেহেশতের যুবকদের নেতা ইমাম হুসাইনের এই মহান ত্যাগ ও কোরবানী কি পূর্বাপর সম্পর্কহীন নিছক একটি দুর্ঘটনা;নাকি ভাগ্যের অপব্যাখ্যাকারী পাপিষ্ঠ ইয়াযীদের ভাষায় ‘অদৃষ্টের লিখন’;নাকি বেহেশতের দুর্নিবার লোভে লোভাতুর ও শহীদের মর্যাদা পিয়াসী একদল আত্মাহুতিদানকারীর কর্মকৌশলবিহীন আত্মদান;নাকি খৃস্টবাদের ইসলামী সংস্করণবাদীদের মত অনুযায়ী ইমাম হুসাইন তাঁর আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে কিয়ামত পর্যন্ত তাঁর প্রেমিকদের পাপ মোচন করে দিয়েছেন। তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে জ্ঞানী ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটি কি সত্যিই কাহিনীকারদের মত অনুযায়ী পথ ভুলতে ভুলতে কারবালা প্রান্তরে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন? আর সত্যিই কি দু’দল মুসলমানের ভুল বোঝাবোঝির মাঝেই কারবালার মহা ঘটনার পটভূমি লুকায়িত? ইমাম হুসাইন কি রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের জন্যই ইয়াযীদের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছিলেন? ‘ইয়াযীদ ইমাম হুসাইনকে বাইয়াত বা আনুগত্যের জন্য চাপ দিচ্ছিল’-এজন্যই কি ইমাম তার বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন? বাইয়াতের জন্য চাপ দেয়ার পূর্বে কি ইমাম ইয়াযীদী শাসন সম্পর্কে কিছু না বলে চুপচাপ ইবাদতে মশগুল ছিলেন? কি কারণেই বা তিনি আসন্ন হজ্বের মাত্র কিছুদিন পূর্বে মক্কা ত্যাগ করে কুফাভিমুখে রওয়ানা হলেন? সর্বোপরি মহানবী (সা.)-এর ওফাতের মাত্র ৫৩ বছর পর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সাহাবীর জীবদ্দশায় কিভাবে ইয়াযীদের বিচ্যুত শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলো? কিভাবেই বা মহানবীর প্রিয় দৌহিত্র নির্মমভাবে মজলুম অবস্থায় শহীদ হলেন। কেনই বা এই মহামানবের এতো বড় আত্মত্যাগের ঘটনাটির ওপর নানা ধুম্রজাল তৈরি করে আজো তাঁকে মজলুম করে রাখা হয়েছে?

কারবালার মহাবিপ্লবকে ধামাচাপা দেয়ার ইয়াযীদী অপকৌশল ও অপপ্রচার এসব হাজারো প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এসব প্রশ্নের বিশেষণধর্মী জবাব পেতে হলে আমাদের জানতে হবে ইমাম হুসাইন কে? তাঁর পরিচয় ও অবস্থান কি? জানতে হবে তৎকালীন সমাজ-পরিস্থিতি ও ঐ সমাজের বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। কারবালা ট্রাজেডির ঘটনাপ্রবাহ। আশুরার পূর্বের ও পরের প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব। আর পরবর্তী প্রজন্মের সাথে এ ঘটনার সম্পর্ক। আলোকিত সমাজ বিনির্মাণকামীদের জন্য প্রয়োজন এই মহাবিপ্লবের নেতা ইমাম হুসাইনের জীবনের প্রামাণ্য সূত্রভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ জীবন ইতিহাসের সাথে পরিচিত হওয়া।

 

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

সাহাবী হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির (রা.)-এর সাথে দুঃখজনক আচরণ ও চরম দুর্ব্যবহার

সাহাবী হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির (রা.) ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে বনী মাখযুম গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সমবয়সী। তাঁর মাতার নাম সুমাইয়া বিনতে খাইয়াত যিনি বনী মাখযুম প্রধান আবু হুযাইফার দাসী। কুরাইশ গোত্রের আর অন্য কোন দাসী হযরত সুমাইয়ার মত মহানুভব,বুদ্ধিমতী,দয়ালু,বিশ্বস্ত,শালীন,ভদ্র ও চরিত্রবান ছিল না। হযরত আম্মারের পিতা ইয়াসির ইবনে আমের ছিলেন উনাস বংশীয়। এই উনাস গোত্র ছিল ইয়ামানের মাযহাজী কাহ্তানীয় আরবদের অন্তর্ভুক্ত। স্মর্তব্য,আম্মার এবং তাঁর পিতা-মাতা ইসলামের প্রথম যুগের মুসলমান। অর্থাৎ তাঁরা ‘আস্ সাবেকুনাল আওয়ালুন’-এর অন্তর্ভুক্ত। আম্মারের পিতা-মাতা ইয়াসির ও সুমাইয়া ইসলামের প্রথম শহীদ। পাপিষ্ঠ আবু জাহল তাঁদের নৃশংসভাবে হত্যা করে। হযরত আম্মারও ইসলাম ধর্ম গ্রহণের কারণে কুরাইশদের বিশেষ করে আবু জাহলের হাতে অত্যাচারিত ও অবর্ণনীয় দৈহিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। মহানবীর নিম্নোক্ত হাদীসগুলো থেকে হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসিরের সুমহান ব্যক্তিত্ব,উচ্চ মর্যাদা ও ঈমান সম্পর্কে আমরা জানতে পারি।

আলী ইবনে আবি তালিব থেকে বর্ণিত : “আমি নবী (সা.)-এর কাছে বসেছিলাম। ইত্যবসরে আম্মার ইবনে ইয়াসির সেখানে প্রবেশের অনুমতি চাইলেন। তখন নবী (সা.) বললেন : তাকে আসার অনুমতি দাও। এ পবিত্র ব্যক্তির আগমন মুবারক হোক।”১

হানী ইবনে হানী (রা.) থেকে বর্ণিত : তিনি বলেন,“একদা আম্মার আলীর কাছে উপস্থিত হন। তখন তিনি বলেন : এই পবিত্র ব্যক্তির আগমন মুবারক হোক। আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-কে বলতে শুনেছি,আম্মারের গলা পর্যন্ত ঈমানে ভরপুর।”২

হযরত আয়েশা থেকে বর্ণিত : তিনি বলেন,“রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন : আম্মার এমন ব্যক্তি দু’টি বিষয়ে তাকে ইখতিয়ার দেয়া হলে সে এর থেকে হেদায়েতে পরিপূর্ণ বিষয়টি ইখতিয়ার করে।”৩

আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,“রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :

أبشر يا عمّار تقتلك الفئة الباغية

হে আম্মার! সুসংবাদ গ্রহণ কর,বিদ্রোহী দলটি তোমাকে হত্যা করবে।”৪

আবু ঈসা বলেন,এ অনুচ্ছেদে উম্মে সালামাহ্,আবদুল্লাহ্ ইবনে আম্মার আবু ইউসর ও হুযাইফা (রা.) থেকেও হাদীস বর্ণিত আছে। এ হাদীসটি হাসান,সহীহ এবং আলা ইবনে আবদুর রহমানের রেওয়ায়েত হিসেবে গরীব।

আমরা ইতোমধ্যে উল্লেখ করেছি,আনসার ও মুহাজির সাহাবিগণ হযরত উসমানের অপব্যয়,প্রশাসনিক নীতি এবং বনু উমাইয়্যা প্রশাসনের কর্মকর্তা ও প্রাদেশিক গভর্নরদের সীমাহীন দুর্নীতি ও অপরাধসমূহের কারণে তীব্র অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। সত্য ও ন্যায়পন্থী সাহাবী হযরত আম্মারও স্বাভাবিকভাবে প্রতিবাদী ও সমালোচনামুখর হয়েছিলেন এবং উদ্ভূত পরিস্থিতির সুষ্ঠু প্রতিকার ও সমাধান করার জন্য তিনি আন্তরিকভাবে চেষ্টাও চালিয়েছিলেন। একদিন কতিপয় সাহাবী হযরত যুবাইর,তালহা ও মিকদাদের সাথে মিলিত হয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা ও আলোচনার পর সর্বসম্মতিক্রমে খলীফা উসমানের কাছে একটি চিঠি লেখার জন্য সিদ্ধান্ত নেন। তাঁরা চিঠিতে খলীফার নীতি ও কার্যকলাপের তীব্র সমালোচনা করেন। তাঁরা খলীফাকে তাঁর কৃত কার্যকলাপের জন্য অনুতাপ করে পদত্যাগ করারও আহবান জানান।

চিঠিটি লেখার পর হযরত আম্মার এবং আরও দশ ব্যক্তি তা খলীফা উসমানের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য রওয়ানা হলেন। একে একে সকলেই সরে পড়লে হযরত আম্মার একাই চিঠিটি খলীফা উসমানের কাছে হস্তান্তর করলেন। খলীফা উসমান চিঠিটি পড়ে জিজ্ঞেস করলেন,“এ চিঠি কি আপনি লিখেছেন?” আম্মার জবাব দিলেন,“হ্যাঁ আমিই লিখেছি।” তখন খলীফা উসমান জিজ্ঞেস করলেন,“এ চিঠি কি আপনি একাই লিখেছেন?” আম্মার উত্তর দিলেন,“আমি একা লিখি নি। আমার সাথে আরও কয়েকজন ছিলেন।” খলীফা উসমান তখন জিজ্ঞেস করলেন,“আপনি আমাকে তাদের নামগুলো বলুন।” আম্মার জবাবে বললেন,“আমি কোনক্রমেই তাঁদের নাম বলব না।” হযরত উসমান এ কথা শুনে বললেন,“অন্যরা যখন ভয় পেল তখন আপনি কেন একাকী এ পদক্ষেপ নিলেন?”

ঐ সময় মারওয়ান খলীফা উসমানকে বলল,“আর কতক্ষণ আপনি এ কালো দাসের সামনে ধৈর্যধারণ করবেন? এ লোকটিই জনগণকে আপনার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলেছে। আপনি যদি তাকে হত্যা করেন তাহলে যারা তাকে সাহায্য করছে তারা ভয় পাবে। আর অন্যান্য বিদ্রোহী জনগণও তার হত্যা থেকে শিক্ষা নেবে।”

মারওয়ানের কথা শোনার পর খলীফা উসমান হযরত আম্মারকে প্রহার করার আদেশ দেন। আদেশপ্রাপ্ত হয়ে খলীফার দাসেরা আম্মারকে প্রহার করতে লাগল এবং খলীফাও তাদের সাথেঅংশগ্রহণ করলেন। তারা তাঁকে এতটা মারল যে,তিনি হার্নিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন এবং অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যান। তাঁকে মাটি থেকে তুলে এনে রাস্তায় পরিত্যক্ত বস্তুর মত ছুঁড়ে ফেলা হয়।

এ ঘটনা ঘটার পর উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালামাহ্ শোরগোলের কারণ জানার জন্য সেখানে আসলেন এবং অজ্ঞান আম্মারের কাছে গেলেন। যখন তিনি আম্মারকে অচেতন অবস্থায় দেখতে পেলেন তখন তিনি তাঁকে তাঁর ঘরে আনার নির্দেশ দিলেন। লোকেরা আম্মারকে হযরত উম্মে সালামার ঘরে বহন করে আনল। সেখানে আম্মার সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পড়ে রইলেন যার ফলে তাঁর যোহর,আসর,মাগরিব ও এশার নামায ক্বাযা হয়ে গেল।

সংজ্ঞা ফিরে এলে হযরত আম্মার দেখতে পেলেন উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালামাহ্,আয়েশা ও হাফসা এবং যারা তাঁর সাথে কলহ করেছিল তারা সকলেই তাঁকে ঘিরে রেখেছে। তখন তিনি মহান আল্লাহর প্রশংসা করলেন। তাঁর ক্বাযা নামাযগুলো আদায় করলেন। নামাযান্তে তিনি আবু জাহলের কীর্তিকলাপ স্মরণ করিয়ে বললেন,

الحَمْدُ لله ليسَ هذا أوَّلَ يومٍ أُوْذينا في اللهِ

“এই প্রথমবারের মত আমি প্রহৃত হই নি;বরং এর আগেও আমি মহান আল্লাহর পথে অত্যাচারিত ও নির্যাতিত হয়েছি।”

হযরত আম্মারকে প্রহার ও সংজ্ঞাহীন হয়ে যাওয়ার পর খলীফা উসমান তাঁর বাড়ী থেকে বের হয়ে দেখতে পেলেন,বনু মাখযুম সেখানে একত্রিত হয়ে হৈ চৈ করছে এবং তাদের নেতা হিশাম বিন ওয়ালীদ বিন মুগীরাহ্ও সেখানে উপস্থিত এবং তাঁদের সহযোগীরা আম্মারের প্রতি যে অপমান করা হয়েছে সে কারণে খুবই চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন।

হযরত আম্মারের মুমূর্ষু অবস্থা স্মরণ করে খলীফা উসমানের দিকে লক্ষ্য করে হিশাম বলেছিলেন,“মহান আল্লাহর শপথ,আম্মার মারা গেলে আমি অবশ্য অবশ্যই বনু উমাইয়্যার একজন বয়োজ্যেষ্ঠ নেতাকে হত্যা করব।”

হযরত আম্মারের প্রতি এ নিষ্ঠুর আচরণ জনগণের মনে তীব্র অসন্তোষ ও ক্ষোভের অগ্নি প্রজ্বলিত করেছিল। কিন্তু খলীফার কর্মকর্তা ও কর্মচারিগণ এ সব ঘটনা থেকে কোন শিক্ষাই গ্রহণ করে নি। কারণ তারা মনে করত,তারা কোনভাবে জনগণকে দমন করতে সক্ষম হবে। এত সব নির্যাতন ও লাঞ্ছনার পরও হযরত আম্মার হযরত উসমানের হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেন নি;বরং তিনি এ ক্ষেত্রে হযরত আলী (আ.)-এর পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিলেন।৫

এ ছাড়াও অপর যে ঘটনাটি হযরত আম্মারের খলীফার রোষানলে পড়ার কারণ তা ছিল এ রকম যে,হযরত আম্মার খলীফাকে না জানিয়েই সাহাবী আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদের জানাযার গোসল দিয়েছিলেন,নামায পড়েছিলেন এবং জান্নাতুল বাকী গোরস্তানে দাফন করেছিলেন। আর যখন উসমান এ ব্যাপারটি জানতে পারলেন তখন তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন এবং হযরত আম্মারকে প্রহার ও তিরস্কার করেছিলেন।৬

এখন আমরা নীচে কয়েকজন প্রাদেশিক শাসনকর্তার বিবরণ প্রদান করব যা থেকে খলীফা উসমানের প্রশাসনের বিচ্যুতি আমাদের সামনে পরিষ্কার হয়ে যাবে।

আল-ওয়ালীদ ইবনে উকবাহ ইবনে আবী মুয়ীত : সে ছিল খলীফা উসমানের বৈপিত্রেয় ভাই। তার পিতা উকবাহ ইবনে আবী মুয়ীত মহানবী (সা.)-কে সবচেয়ে বেশি নির্যাতন করত ও যাতনা দিত। ওয়ালীদ ব্যভিচারী ও মদ্যপ হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। আর তার ছিল খ্রিস্টান পানসঙ্গী।৭

খলীফা উসমান ওয়ালীদকে কুফার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন। সে তার পানসঙ্গী ও গায়িকাদের সাথে রাতের প্রথমাংশ থেকে প্রভাত পর্যন্ত মদ্যপানে লিপ্ত থাকত। একদিন সে কুফায় ফজরের জামায়াতের নামায দু’রাকাতের স্থলে চার রাকাত পড়িয়ে বলল,“তোমাদের নামাযের রাকাতের সংখ্যা আরো বাড়াব কি?” মসউদী থেকে বর্ণিত,“ওয়ালীদ সিজদায় বলছিল,“পান কর এবং আমাকে পান করাও।”৮

অবশেষে যখন জনসাধারণ এ ব্যাপারে উত্তেজিত হয়েউঠে,তখন খলীফা উসমান তাকে মাত্র চল্লিশটি দুররা মারার আদেশ দেন এবং তাকে পদচ্যুত করে তদস্থলে সায়াদ ইবনে ইলাসকে নিযুক্ত করা হয়।৯

আবদুল্লাহ্ ইবনে সা’দ আল-আমেরী : সে মহানবী (সা.)-এর ওহী লেখক ছিল। ওহী লিখার সময় তার বিশ্বাসঘাতকতা প্রকাশ পেলে মহানবী তাকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সে মুরতাদ হয়ে গিয়েছিল এবং মক্কাবাসীদের সাথে যোগ দিয়েছিল এবং তাদের বলত,“আমি আমার খেয়াল খুশীমত মুহাম্মদকে ব্যবহার করতাম। তিনি আমাকে عزيزٌ حكيم (অত্যন্ত পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়) লিখতে বললে আমি লিখতাম عليم حكيم (সর্বজ্ঞ প্রজ্ঞাময়)।” তাই মহান আল্লাহ্ তার সম্পর্কে অবতীর্ণ করলেন,

و من أظلمُ ممّنِ افترى على الله كذباً ...

“যে মহান আল্লাহর ওপর মিথ্যারোপ করেছে তার চাইতে অধিকতর জালেম আর কে আছে...?”

এরপর মহানবী (সা.) তার রক্তকে বৈধ ও মূল্যহীন ঘোষণা করেন। মক্কা বিজয়ের পরে হযরত উসমান মহানবীর কাছে তার জীবন রক্ষার আবেদন করলে মৃত্যুদণ্ডাদেশ থেকে সে মুক্তি পেয়েছিল। সে ছিল হযরত উসমানের খালাত ও দুধ ভাই।১০

হযরত উসমান তার খিলাফতকালে পশ্চিম আফ্রিকা বিজয় থেকে যা অর্জিত হয়েছিল তার সবটুকু আবদুল্লাহকে দিয়েছিলেন।১১ এরপর খলীফা উসমান আমর ইবনে আসের স্থলে তাকে মিসরের গভর্নর নিযুক্ত করেছিলেন।১২

মিসরের অধিবাসিগণ শাসনকর্তা আবদুল্লাহ্ ইবনে সা’দের ক্রিয়া-কলাপে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট ছিল এবং তার বিরুদ্ধে মদীনায় অভিযোগ করলে খলীফা উসমান তা গ্রাহ্য করতেন না বলে তারা খলীফার বিরুদ্ধেও ভীষণ অসন্তুষ্ট হয়ে পড়ে।১৩

মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান : মুয়াবিয়া স্বীয় পিতা আবু সুফিয়ানের অধীনে মহানবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধসমূহে অংশগ্রহণ করতেন। তিনি বদর,উহুদ ও খন্দক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। মক্কা বিজয়ের পর তিনি মুসলমান হয়েছিলেন (অর্থাৎ তিনি তুলাকাদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন)। মহানবী তাঁকে হুনাইনের যুদ্ধের গনীমত থেকে মুআল্লাফাতুল কুলূবের অংশ প্রদান করেছিলেন।১৪ তিনি মহানবীর জীবদ্দশায় মদীনায় প্রায় দেড় বছর বসবাস করেছিলেন। খলীফা আবু বকর তাঁর ভ্রাতা ইয়াযীদ ইবনে আবু সুফিয়ানকে এক সেনাদলের প্রধান করে সিরিয়া প্রেরণ করলে মুয়াবিয়া উক্ত সেনাদলে যোগদান করে তথায় গমন করে। সুফিয়ানের মৃত্যুর পর খলীফা উমর মুয়াবিয়াকে তাঁর ভ্রাতার সেনাদলের সেনাপতি নিযুক্ত করেন। আর হযরত উসমান খলীফা হয়েই শামের সকল শহর ও অঞ্চলের শাসনকর্তাদের বরখাস্ত করে সমগ্র এলাকা অর্থাৎ সিরিয়ার সকল ভূখণ্ডের শাসনভার মুয়াবিয়ার ওপর ন্যস্ত করেন। খলীফা উসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দেখা দিলে তিনি (খলীফা) মুয়াবিয়ার কাছে সাহায্যের আবেদন করেন। তখন সে একদল সৈন্য প্রেরণ করে তাদের নির্দেশ দিয়েছিল যেন তারা মদীনার ভিতরে প্রবেশ না করে। খলীফা উসমানের মৃত্যু পর্যন্ত উক্ত সেনাদল মদীনার বাইরে অবস্থান করতে থাকে। এরপর মুয়াবিয়া ঐ সেনাদলকে সিরিয়ায় ফিরিয়ে আনেন।

মুয়াবিয়া রোমান সম্রাট ও পারস্যের রাজা-বাদশাদের ন্যায় রাজকীয় জৌলুসপূর্ণ উদ্ধত বিলাসবহুল জীবন যাপন করতেন। রাজকীয় মেজাজ ও চাল-চলনের কারণেই তাঁকে ‘আরবের খসরু’ বলা হতো। তিনি খলীফা উসমানের প্রশাসনিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সিরিয়ায় একেবারে স্বাধীন নৃপতির মত শাসনকার্য পরিচালনা করতে থাকেন। তিনি বাইতুল মাল যথেচ্ছ ব্যবহার করতেন।

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল তাঁর মুসনাদ গ্রন্থের ৫ম খণ্ডে আবদুল্লাহ ইবনে বুরাইদার সূত্রে বর্ণনা করেছেন : আমি ও আমার পিতা একবার মুয়াবিয়ার কাছে গেলাম। তিনি আমাদের কার্পেটের ওপর বসালেন এবং আমাদের কাছে খাবার আনালে আমরা তা খেলাম। এরপর তিনি শরাব আনালেন। অতঃপর মুয়াবিয়া তা পান করলে আমার পিতাও তা থেকে পান করলেন এবং বললেন : মহানবী যখন থেকে তা হারাম করেছেন তখন থেকে তা আর পান করি নি।”১৫

উটের পিঠে হাট-বাজারে ও পথে-ঘাটে যেখানেই তার জন্য মদ বহন করে নিয়ে যাওয়া হতো সেখানেই মুয়াবিয়া মদ্যপান থেকে বিরত থাকতেন না।১৬

এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ্য,দুনিয়াত্যাগী সাধক সাহাবী হযরত আবু যারকে মদীনা থেকে শামে প্রেরণ করা হলে শামে এসে যখন তিনি মুয়াবিয়ার সীমাহীন ভোগ-বিলাস,বিচ্যুতি ও অপকর্মসমূহ প্রত্যক্ষ করেছিলেন তখন তিনি এর তীব্র প্রতিবাদ করতে থাকেন এবং সেখানকার জনগণকে মুয়াবিয়ার বিচ্যুতি ও অপকর্মগুলো সম্পর্কে অবগত করেছিলেন। অবস্থা বেগতিক দেখে মুয়াবিয়া সাহাবী আবু যারকে মদীনায় ফেরত পাঠান।

একটি সুপরিকল্পিত অপবাদ ও মিথ্যাচার

হযরত উসমানের অব্যবস্থাপনা,শাসনকার্য পরিচালনা করার ক্ষেত্রে অদক্ষতা,শরীয়তের কতিপয় বিধানের পরিবর্তন সাধন ও মুসলিম উম্মাহর বাইতুল মালের অর্থ ও সম্পদ বিনা হিসেবে ও অসমীচীনভাবে নিজ আত্মীয়-স্বজন,জ্ঞাতি ও বন্ধু-বান্ধবদের দান এবং তাঁর প্রাদেশিক শাসনকর্তা,গভর্নর,সরকারী কর্মচারী এবং বনু উমাইয়্যার সীমাহীন দুর্নীতি,অপরাধ ও শরীয়তবিরোধী কার্যকলাপ তাঁর বিরুদ্ধে গণঅসন্তোষ ও বিপ্লবের পটভূমিকা ও ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেয়।

অবস্থা এতটা গুরুতর ও ন্যাক্কারজনক হয়ে গিয়েছিল যে,হযরত আয়েশা,তালহা,যুবাইর,আমর ইবনে আস ও অন্যান্য ব্যক্তি যাঁরা পরে হযরত উসমানের হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার দাবিতে হযরত আলীর বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে বিদ্রোহ করেছিলেন এবং সমগ্র ইসলামী নীতিবোধ ও বিধি-বিধান উপেক্ষা করে ও বিসর্জন দিয়ে হাজার হাজার মুসলমানের রক্ত ঝরিয়েছিলেন তাঁরাই জনগণকে হযরত উসমানের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ ও সুসংগঠিত করেছিলেন এবং খলীফাকে হত্যাযোগ্য বলে মনে করতেন। ‘তোমরা নাসালকে হত্যা করে ফেল,মহান আল্লাহ্ নাসালকে হত্যা করুন’ (أُقتلوا نعثلاً، قتلَ الله نعثلاً)- হযরত উসমান প্রসঙ্গে এ উক্তিটি হযরত আয়েশা থেকে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।

ইবনে আসীর ‘জাযারী আন্-নিহায়াহ্’ গ্রন্থে বলেছেন,এ উক্তিটি হযরত আয়েশা ঐ সময় করেছিলেন যখন তিনি মক্কা যাচ্ছিলেন এবং হযরত উসমানের প্রতি তখন তিনি তীব্রভাবে অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত ছিলেন। নাসাল মিসরীয় এক ব্যক্তির নাম ছিল যার দাঁড়ি ছিল অত্যন্ত লম্বা। কেউ কেউ বলেছেন,বোকা বৃদ্ধকে ‘নাসাল’ বলা হয়। নিহায়াহ্ গ্রন্থে নাসাল ধাতু দ্রষ্টব্য;ইবনে আবীল হাদীদ প্রণীত শারহু নাহজিল বালাগাহ্,দ্বিতীয় খণ্ড,পৃ. ৭৭;হযরত আয়েশা থেকে উপরিউক্ত উক্তিটির উদ্ধৃতি দেয়ার আগে বলেছেন,“যে কোন লেখকই সীরাত গ্রন্থ ও হাদীস গ্রন্থ রচনা করেছেন তাঁরা এ ব্যাপারটি উল্লেখ করেছেন যে,হযরত আয়েশা ছিলেন হযরত উসমানের সবচেয়ে কড়া সমালোচক ও বিরোধী। এমনকি তিনি [হযরত আয়েশা] মহানবী (সা.)-এর একটি পোশাক নিজ ঘরের দরজার সামনে ঝুলিয়েছিলেন। যে কেউ তাঁর ঘরে আসলে তিনি তা তাদের দেখিয়ে বলতেন,

هذا ثوب رسول الله لم يبل و عثمان قد أبلى سنّة رسول الله

এটি মহানবী (সা.)-এর পোশাক যা এখনো পুরনো হয় নি,অথচ উসমান রাসূলের সুন্নাতকে পুরোনো করে ফেলেছে।

হযরত আয়েশা হযরত উসমানের বিরোধিতা এবং তাঁর (হযরত উসমানের) হত্যাকাণ্ডের পর হযরত আলীর বিরুদ্ধে উসমান হত্যার প্রতিশোধের কথা বলে অহেতুক বিদ্রোহ ও যুদ্ধ করেছিলেন। এতদসংক্রান্ত বিবরণ আমরা খিলাফতের ইতিহাস গ্রন্থ থেকে এখানে তুলে ধরছি।

‘একটি বড় অশান্তির বুনিয়াদ কায়েম হইল হযরত আয়েশার দ্বারা। তিনি মদীনা হইতে মক্কায় গিয়াছিলেন হজ্জ করিবার উদ্দেশ্যে। মদীনায় ফিরিবার পথে তিনি খবর পাইলেন হযরত উসমান শহীদ হইয়াছেন এবং হযরত আলী তদস্থলে খলীফা নির্বাচিত হইয়াছেন। হযরত উসমানের কার্যাবলী তিনি না-পছন্দ করিতেন। হযরত আলী সম্বন্ধে তিনি মিশ্র মনোভাব পোষণ করিতেন রাসূলে করিম (সা.)-এর জীবনকাল হইতেই।...

যাহা হোক,হযরত আয়েশা খবর শুনিয়া বলিয়া উঠিলেন,“যখন হযরত আলী খলিফা হইয়াছেন,তখন মদীনায় বসবাস করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।” এই বলিয়া তিনি মক্কায় ফিরিয়া গেলেন। তালহা এবং যুবাইর এই ঘটনাকে সুযোগ মনে করিয়া মক্কায় গিয়া তাহার সহিত মিলিত হইলেন।... তালহা এবং যুবাইর মক্কায় পৌঁছিয়া হযরত আয়েশাকে উত্তেজিত করিতে লাগিলেন,যেন তিনি উসমানের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য হযরত আলীর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন। পাঠকগণের এ কথা নিশ্চয়ই স্মরণ আছে যে,হযরত উসমানের বিরুদ্ধে জনসাধারণ যখন অসন্তুষ্ট ছিল,তখন খিলাফতের দায়িত্ব পরিত্যাগ না করিয়া আঁকড়াইয়া ধরিয়া থাকা তাহার পক্ষে কতটা সমীচীন ছিল। আবার মাবিয়া এবং হযরত আয়েশা হযরত আলীর বিরুদ্ধে যে মিথ্যা দোষারোপ করিয়া বিদ্রোহ করিলেন,তাহাও কতটা সমীচীন ছিল,কিংবা হযরত আলীর পক্ষে গোলযোগ ও অশান্তির ভয়ে খিলাফতের দায়িত্ব ঐ অবস্থায় পরিত্যাগ করিয়া সড়িয়া দাঁড়ানো মুসলিম জনসাধারণের জন্য কত বড় ক্ষতির কারণ হইতে পারিত,এ কথা নিরপেক্ষ পাঠক নিরাসক্ত মনে বিচার করিলে অবশ্যই সঠিক ধারণায় পৌঁছিতে পারিবেন।...

মাবিয়া হযরত আলীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিবার যে অভিসন্ধি খুঁজিতেছিলেন তালহা,যুবাইর ও হযরত আয়েশার কার্যক্রম গ্রহণের ফলে তাহা জোরদার হইয়া উঠিল।...

হযরত আলীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা যে সঠিক কাজ হইতেছে না,সম্ভবত হযরত আয়েশা তাহা উপলব্ধি করিয়া তাহার অন্যতমা সতিন হযরত উম্মে সালামাকে বলিলেন,“উসমানের রক্তের প্রতিশোধ লওয়া দরকার।” হযরত উম্মে সালামা বলিলেন,“আয়েশা! কাল তুমি উসমানের খিলাফতের কত নিন্দা করিয়াছ। আর আজ তাহার সমর্থক হইয়া বিনা কারণে হযরত আলীর বিরুদ্ধাচরণ করিতেছ,তোমার এরূপ আচরণ দেখিয়া আমি অত্যন্ত তাজ্জব হইয়াছি।” তারপর তিনি (আয়েশা) হযরত হাফসার সাহায্যপ্রার্থী হইলেন। কিন্তু আব্দুল্লাহ ইবনে উমর হাফসাকে জানাইলেন নবী করিম (সা.)-এর সহধর্মিনিগণ একে একে সকলেই হযরত আয়েশাকে সাহায্য দান করিতে অস্বীকার করিয়াছেন।...

...[বসরায় উটের যুদ্ধ শুরু হবার প্রাক্কালে] হযরত আলী (আ.) জনৈক ব্যক্তিকে হযরত আয়েশার নিকট প্রেরণ করিলেন। তাহাকে বলিয়া দিলেন,উম্মুল মুমিনীনকে যেন স্মরণ করাইয়া দেওয়া হয় যে,তিনি নবী করিম (সা.)-এর ওসিয়ত অমান্য করিয়া মদীনার বাহিরে আসিয়াছেন।...১৭

তালহা ছিলেন ঐ ব্যক্তি যিনি হযরত উসমান যে দিবসে নিহত হন সেই দিন (তাবারী,বালাযুরী ও অন্যান্য ঐতিহাসিকের বর্ণনানুসারে) জনগণকে হযরত উসমানকে হত্যা করার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি প্ররোচিত করেছিলেন১৮ এবং মানুষের ঘরের ছাদ দিয়ে হযরত উসমানের ঘরে ঢোকার পথ দেখিয়ে দিয়েছিলেন,এমনকি তিনি হযরত উসমানের ঘরে পানি সরবরাহ করার ক্ষেত্রে বাধা দিয়েছিলেন১৯ এবং হত্যাকাণ্ডের পর তিনদিন পর্যন্ত নিহত খলীফার লাশ দাফন করতে দেন নি। অবশেষে তিনি জান্নাতুল বাকী গোরস্তানেও খলীফার লাশ দাফন করতে দেন নি।...২০

বসরায় জঙ্গে জামাল (উষ্ট্রের যুদ্ধ)-এর দিবসে তালহা যুদ্ধক্ষেত্রের এক পাশে দাঁড়ালে শয়তান-প্রকৃতি মারওয়ান তাঁকে দেখে বলেছিল,“এই এক আজব ব্যক্তি। বিদ্রোহিগণের সাথী হইয়া উসমানকে সে হত্যা করিয়াছে। আবার এখন শোক-প্রকাশক দলের সাথী হইয়া সেই হত্যার প্রতিশোধ চাহিতেছে।”২১

হযরত যুবাইরও জনগণকে প্ররোচিত করে বলেছিলেন,“তোমরা উসমানকে হত্যা কর;কারণ সে তোমাদের ধর্ম পরিবর্তিত করে দিয়েছে।” যখন তাঁকে বলা হলো : আপনার ছেলে আবদুল্লাহ্ তো উসমানকে রক্ষার জন্য তাঁর ঘরের দরজায় দণ্ডায়মান আছে। তখন যুবাইর বলেছিলেন,“উসমান নিহত হোক তাতে আমি সন্তুষ্ট,এমনকি আমার ছেলে আবদুল্লাহ্ও তার সাথে নিহত হলেও...।”

আর এ কারণেই উষ্ট্রের যুদ্ধের দিনে হযরত আলী (আ.) যুবাইরকে বলেছিলেন,“যুবাইর! তুমি এখানে কেন এসেছ?” যুবাইর উত্তর দিলেন,“উসমানের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য।” তখন হযরত আলী (আ.) বলেছিলেন,“তুমি এবং তোমার বন্ধুরাই তাঁকে হত্যা করেছ। অতএব,তোমাদের নিজের ওপরেই সে প্রতিশোধ গ্রহণ করা উচিত।”২২

আমর ইবনে আসকে যেহেতু হযরত উসমান মিসরের গভর্নরের পদ থেকে অপসারণ করেছিলেন সেহেতু তিনিও অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে হযরত উসমানের কাছে আসেন এবং খুবই অকথ্য ও নোংরা ভাষায় তাঁদের মধ্যে বচসা হয়। আমর ইবনে আস ছিলেন হযরত উসমানের ভগ্নিপতি। তিনি এতটা ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে,তিনি তাঁর স্ত্রীকে (উসমানের বোনকে) তালাক দিয়েছিলেন এবং ক্রোধবশত তিনি ফিলিস্তিনে চলে যান। তিনি যেখানেই যেতেন সেখানেই জনগণকে হযরত উসমানের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করতেন ও ক্ষেপিয়ে তুলতেন...।২৩

হযরত উসমান যখনই বিপ্লবীদের ব্যাপারে মুয়াবিয়ার সাহায্য চেয়েছেন তখনই মুয়াবিয়া তাঁকে সাহায্য করা থেকে বিরত থেকেছেন। তিনি খলীফার পুনঃপুন প্রেরিত চিঠিগুলোর কোন জবাবই দেন নি। খলীফা উসমান নিহত হওয়ার পর এ ব্যাপারে হযরত আলী (আ.) মুয়াবিয়াকে বলেছিলেন,

فوالله ما قتل ابن عمّك غيرك

“মহান আল্লাহর শপথ! তুমি ব্যতীত আর কোন ব্যক্তিই তোমার চাচাতো ভাইকে হত্যা করে নি।”২৪

মোদ্দা কথা,হযরত উসমানের দুর্বল প্রশাসনের দুর্নাম ও দুর্নীতি এমনই এক ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করেছিল যে,তাঁরই দয়া-দাক্ষিণ্য ও অনুগ্রহপ্রাপ্তগণই অর্থাৎ সুসময়ের বন্ধু ও সুবিধাভোগীরা তাঁর দুর্দিনে তাঁর নিকট থেকে দূরে সরে গিয়েছিল। কিন্তু খলীফা উসমানের হত্যাকাণ্ডের পর এ সব দুনিয়াদার ও পদলোভী ব্যক্তি আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)-এর ন্যায়পরায়ণতাভিত্তিক শাসন-ব্যবস্থার মুখোমুখি হয়েই নিজেদের প্রতিজ্ঞা ও বাইয়াত ভঙ্গ করে তাঁর বিরোধিতায় লিপ্ত হন এবং হযরত উসমানের হত্যাকাণ্ডের বদলা গ্রহণ করার বাহানায় বিদ্রোহ ও যুদ্ধের পতাকা উত্তোলন করেন। এ সব বিদ্রোহ,বাইয়াত ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ এবং যুদ্ধবিগ্রহের কারণে অপবিত্র বিষবৃক্ষ অত্যাচারী বনু উমাইয়্যার বাদশাহী ও কুশাসন জগদ্দল পাথরের মত মুসলিম উম্মাহর টুটি চেপে ধরেছিল এবং তাদের এ কুশাসন ও অন্যায়-অত্যাচার দীর্ঘ ৮০ বছর কাল স্থায়ী হয়েছিল। এ সময় বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি,অপরাধ ও অপকর্মের পাশাপাশি বনু উমাইয়্যা নিজেদের ও তাদের সমর্থকদের স্বার্থে ব্যাপক প্রচার-প্রপাগাণ্ডা,অগণিত জাল ও মিথ্যা হাদীস তৈরি করে তা মহানবী (সা.)-এর সুন্নাহ্ ও হাদীস বলে চালিয়ে দেয়। আর এ কারণেই মহানবীর পবিত্র সুন্নাহ্ ও বিশুদ্ধ রেওয়ায়েতসমূহের পাশাপাশি অনেক বিকৃত ও বানোয়াট হাদীস ও রেওয়ায়েত প্রচলিত হয়ে যায়।

বনু উমাইয়্যা পরবর্তীকালে তাদের ঘৃণ্য স্বার্থ ও লক্ষ্য অর্জন করার জন্য হযরত আলী (আ.) ও তাঁর দু’সন্তান ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন কর্তৃক হযরত উসমানকে সমর্থন দান এবং তাঁকে হত্যা করার ব্যাপারে তাঁদের বিরোধিতা সংক্রান্ত কতিপয় হাদীস ও বর্ণনা জাল করেছে। যাদের ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান রয়েছে তারা এ সব রেওয়ায়েত ও হাদীসের মিথ্যা ও বানোয়াট হবার বিষয়টি স্পষ্টভাবে অনুধাবন করতে সক্ষম।

উদাহরণস্বরূপ কতিপয় ঐতিহাসিক গ্রন্থে লেখা হয়েছে,হযরত আলী (আ.) উসমান যেদিন নিহত হন সেদিন ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইনকে উসমানের গৃহে প্রেরণ করেছিলেন এবং তাঁদের খলীফার গৃহ হেফাজত করার আদেশ দিয়েছিলেন। তিনি জোর গুরুত্ব দিয়ে বলেছিলেন যেন তাঁরা দু’জন কোন ব্যক্তিকে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতে না দেন। পিতার আদেশ পেয়ে ইমামদ্বয় খলীফার গৃহে গমন করলেন এবং খুব দৃঢ়তার সাথে উক্ত গৃহ হেফাজত করতে লাগলেন। বিদ্রোহীদের আক্রমণে ইমাম হাসান আহত হলেন এবং তাঁর পবিত্র মুখমণ্ডল রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেল...।

যখন খলীফা উসমান নিহত হলেন তখন হযরত আলী,ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন খলীফার বাসগৃহে প্রবেশ করলেন এবং খলীফার রক্তে রঞ্জিত মৃতদেহ দর্শন করে খুব ক্রন্দন করেলেন...। তাঁরা শোকে এতটা মুহ্যমান হয়ে পড়েছিলেন,তাঁদের হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেয়েছিল...। আলীর কণ্ঠে এলোমেলো কথা ধ্বনিত হচ্ছিল এবং তখন তিনি তাঁর দু’ছেলেকে বলছিলেন,“তোমরা দু’জন দরজার কাছে দণ্ডায়মান থাকতে কিভাবে আমীরুল মুমিনীন নিহত হলেন?” এ কথা বলার পর পরই তিনি তাঁর একটি হাত উঠিয়ে ইমাম হাসানকে চড় মারলেন এবং অপর হাত দিয়ে হুসাইনের বুকে আঘাত করলেন। মুহাম্মদ বিন তালহাকে তিনি গালমন্দ করলেন এবং আবদুল্লাহ্ ইবনে যুবাইরকে অভিশাপ দিলেন। তাঁর এমন আচরণের ফলে তালহা কাছে এসে প্রতিবাদ করে বললেন,“হে আবুল হাসান! আপনার হয়েছে কি? আপনি হাসান ও হুসাইনকে মেরেছেন...!”

এ রেওয়ায়েতটি যে বানোয়াট ও মিথ্যা এ ব্যাপারে প্রখ্যাত আলেম ও হাদীসশাস্ত্রবিদগণ বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং তা প্রমাণ করেছেন। তাই আমরা এ ব্যাপারে আর বিস্তারিত আলোচনায় যাচ্ছি না। তবে খলীফা উসমানের হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে নাহজুল বালাগায় হযরত আলী (আ.)-এর উক্তি এ ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য যা থেকে উপরোক্ত বর্ণনাটির সত্যতা বা বানোয়াট হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। বাণীটি নিম্নরূপ :

لو أمَرْتُ به لكُنتُ قاتلاً أوْ نهيتُ عنه لكنت ناصراً، غير أنّ منْ نصره لا يستطيع أن يقول : خذله من أنا خيرٌ منه، و من خذله لا يستطيع أن يقول : نصره من هو خير منّي، و أنا جامع لكم أمره : إشتأْثر فأساء الأثرة، و جزعتم فأسأتم الجزع و لِلّه حكم واقع في المستأْثر و الجازع

আমি যদি তাঁকে (উসমানকে) হত্যা করার আদেশ দিতাম তাহলে আমি হত্যাকারী বলে গণ্য হতাম;আর যদি তাকে হত্যার ব্যাপারে (বিদ্রোহীদের) নিষেধ করতাম তাহলে তাঁর সাহায্যকারী বলে গণ্য হতাম। তবে যে তাকে সাহায্য করেছে সে বলতে পারবে না,“যে তাকে অপদস্থ করেছে তার চেয়ে আমি শ্রেষ্ঠ ও উত্তম। আর যে ব্যক্তি তাকে সাহায্য করে নি সেও বলতে পারবে না,“যে ব্যক্তি তাকে সাহায্য করেছে সে আমার চেয়ে উত্তম।” আর আমি তাঁর প্রকৃত ব্যাপারটি তোমাদের কাছে এভাবে বর্ণনা ও খোলাসা করতে পারি,তিনি এমন একটি কাজ (খিলাফতের দায়িত্ব) বেছে নিয়েছিলেন যে ব্যাপারে তিনি স্বৈরাচার প্রদর্শন করেছেন এবং মন্দভাবে তা সম্পন্ন করেছেন এবং এ ক্ষেত্রে তোমরাও অস্থিরতা ও অধৈর্য প্রদর্শন করেছ এবং খুব মন্দভাবেই তা করেছ। আর খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণকারীর ব্যাপারে এবং এ সব অস্থির ব্যক্তির ব্যাপারে মহান আল্লাহর নির্ধারিত বিধান রয়েছে।২৫

অন্য একটি খুতবায় ইবনে আব্বাস গৃহবন্দী অবস্থায় হযরত উসমানের পক্ষ থেকে হযরত আলীর জন্য যখন একটি বার্তা এনেছিলেন এবং ইয়াম্বু এলাকায় চলে যাওয়ার জন্য তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন তখন তিনি বলেছিলেন,

ما يريدُ عثمان إلّا أن يجعلني جملاً ناضجاً بالغرب أقبل و أدبر بعث إليَّ أن أخرج ثمَّ بعث إليَّ أن أقدمَ ثمَّ هو الآنَ يبعثُ إليَّ أن أخرج، والله لقد دفعتُ عنه حتّى خشيت أن أكون آثماً

“উসমান আমাকে কেবল পানি ও মশক বহনকারী উটের মত ব্যবহার করতে চান অর্থাৎ আমি যেন উক্ত উটের মতো আসি আর যাই। আমার কাছে বার্তা পাঠিয়েছেন যেন আমি (বিদ্রোহীদের কাছে তাদের বোঝাতে) যাই। এরপর পুনরায় বার্তা পাঠিয়েছেন যেন আমি (তাঁর কাছে) আসি। এখন তিনি বার্তা পাঠিয়েছেন যেন আমি যাই (বিদ্রোহীদের বোঝাতে ও শান্ত করতে)। খোদার শপথ! আমি তাঁকে এতটা হেফাজত করেছি যে,আমি ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম পাছে আমি পাপী ও অপরাধী বলে সাব্যস্ত হই।”২৬

আল্লামা বালাযুরীর ‘আনসাবুল আশরাফ’ গ্রন্থে বর্ণিত আছে ;হযরত আলী (আ.) এ ব্যাপারে বলেছেন,

ما أحببتُ قتله ولا كرهته ولا أمرت به ولا نهيت عنه

“তাঁর হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে যেমন আমি খুশী হই নি ঠিক তেমনি তাঁর নিহত হওয়ার ব্যাপারটি অপছন্দও করি নি;আর না আমি (বিদ্রোহীদের) তাঁকে হত্যা করার আদেশ দিয়েছি আর না আমি এ ব্যাপারে নিষেধ করেছি।”২৭

এতদ্প্রসঙ্গে যে সব বর্ণনা ও রেওয়ায়েত আছে তা থেকে প্রতীয়মান হয়,হযরত আলী খলীফা উসমানকে ন্যায়পরায়ণ শাসক বলে মনে করতেন না। যার ফলে তাঁর হত্যাকাণ্ড তাঁকে যেমন মর্মাহত ও শোকাভিভূত করে নি তেমনি তিনি এ বিষয়টির প্রতি গুরুত্বও দেন নি। এ কারণেই তিনি চুপচাপ নিজ ঘরে বসেছিলেন এবং গৃহ অবরোধকারী ও আন্দোলনকারীদের অপরাধী বলে বিবেচনা করেন নি। আর যদি এমন না হতো তাহলে আক্রমণকারী,গৃহ অবরোধকারী ও আন্দোলনকারীদের কাজ তাঁকে অসন্তুষ্ট ও রাগান্বিত করত;আর এর ফলে তিনি তাদের সম্মুখে চুপচাপ বসে থাকতে পারতেন না।... আর যদি তিনি খলীফা উসমানকে ন্যায়পরায়ণ শাসনকর্তা বলেই বিবেচনা করতেন তাহলে তাঁর ব্যাপারে অন্তত এতটুকু বলতেন,তাঁর সাহায্যকারীরা তাঁকে যারা সাহায্য করে নি বরং অপদস্থ করেছে তাদের চেয়ে উত্তম। বরং এটিই সবচেয়ে ন্যূনতম উক্তি যা কোন সাধারণ ন্যায়পরায়ণ মুসলমান সম্পর্কে বলা যায়। আর মুসলিম উম্মার একজন ন্যায়পরায়ণ নেতা সম্পর্কে তো বলার অপেক্ষাই রাখে না।

বাইয়াতের দ্বিতীয় দিনে হযরত আলী (আ.) যে খুতবা দিয়েছিলেন তা থেকে এতদ্প্রসঙ্গে তাঁর অভিমত সম্পূর্ণ পরিষ্কার হয়ে যায়। তিনি বলেছিলেন,

إلا إنَّ كلَّ قطيعةٍ أقطعها عثمان و كلُّ مالٍ أعطاه من مال الله فهو مردودٌ في بيت المال...

“তোমরা জেনে রাখ,বায়তুল মালের সম্পত্তির অন্তর্ভুক্ত যে সব ভূমি উসমান যাকেই দিয়েছেন অথবা মহান আল্লাহর সম্পদ থেকে যাকেই তিনি যে সম্পদ দিয়েছেন তার সবই বাইতুল মালে ফিরিয়ে আনতে হবে...।”

তাই খলীফা উসমান যদি হযরত আলীর কাছে ন্যায়পরায়ণ শাসনকর্তা বলেই বিবেচিত হতেন তাহলে উসমান বাইতুল মাল থেকে যা নিয়েছিলেন এবং দান করেছিলেন তা অবশ্যই তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হতো এবং তা তিনি বাইতুল মালে ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দিতেন না।

সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে,এ সব মিথ্যাবাদী আরও বাড়িয়ে বলেছে,হাসান ইবনে আলী হযরত উসমানের কড়া সমর্থক ছিলেন। তিনি তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত হযরত উসমানের হত্যাকাণ্ডে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি এ ব্যাপারে তাঁর পিতা হযরত আলীকে দোষী মনে করতেন। একদিন হযরত আলী যখন দেখলেন তাঁর ছেলে হাসান ওযু করছেন তখন তাঁকে বললেন,“পূর্ণাঙ্গরূপে ওযু কর।” তখন তিনি (হাসান) তাঁকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন,“আপনারাই তো গত রাতে এমন এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছেন যিনি পূর্ণাঙ্গরূপে ওযু করতেন।”২৮

এখন ড. ত্বাহা হুসাইনের মত এ হাদীস ও রিওয়ায়েতের রাবীদের প্রশ্ন করে দেখা উচিত,আপনারাই বা কেন তাহলে অন্যত্র ঐ সব হাদীস ও রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন যেগুলোতে হযরত উসমানের প্রতি আলীর সমর্থন এবং তাঁকে হত্যা করার কারণে তাঁর ক্রোধ ও অসন্তোষের কথা স্পষ্ট বর্ণিত হয়েছে? এমনকি হযরত আলীর এ উক্তিটিও আপনারা বর্ণনা করেছেন,তিনি ইমাম হাসানের গালে চড় মেরে বলেছিলেন,‘এখানে তোমাদের উপস্থিতি সত্ত্বেও কিভাবে খলীফা নিহত হলেন?’

আপনারা কিভাবে এ দু’টি পরস্পর বিপরীতধর্মী হাদীস একত্র করে এগুলোর বৈপরীত্য ও স্ববিরোধিতা দূর করবেন?

অথবা আপনারা কি জানেন না,এ ধরনের রেওয়ায়েত মাদায়েনীর মত মিথ্যাবাদীদের দ্বারা সৃষ্ট যারা মহানবী (সা.)-এর আহলে বাইতের প্রতি শত্রুতা ও বিদ্বেষ পোষণ করত এবং বনু উমাইয়্যার একনিষ্ঠ সমর্থক ছিল। মহানবীর আহলে বাইতের নিন্দায় এবং ধর্মহীন বনু উমাইয়্যার প্রশংসায় মিথ্যা রেওয়ায়েত ও হাদীসসমূহ জাল ও তৈরি করার বিষয়টি বেশ প্রসিদ্ধ। সনদ ও বিষয়বস্তুর দিক থেকে এ ধরনের হাদীস ও রেওয়ায়েতের কোন মূল্য নেই এবং এগুলো মোটেও নির্ভরযোগ্য নয়।

তারিখে তাবারী ও কিতাবুল ইবারের২৯ মতো কতিপয় ইতিহাস গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে,ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন খলীফা উসমানের শাসনামলে আকাবাহ্ ইবনে নাফে এবং খলীফার দুধভাই আবদুল্লাহ্ ইবনে সারার নেতৃত্বে আফ্রিকা মহাদেশের বেশ কয়েকটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। যার ফলে বেশ কিছু আফ্রিকীয় শহর ও নগর মুসলমানদের করতলগত হয়েছিল।

একইভাবে যে সব যুদ্ধ ইরানে সংঘটিত হয়েছিল সে সব যুদ্ধে এবং বিশেষ করে তাবারিস্তান (মাযেনদারান) বিজয়ের যুদ্ধে ইমাম হুসাইন অংশগ্রহণ করেছিলেন।

এখানে উল্লেখ্য,এ বিষয়টি বহু ঐতিহাসিকদের বক্তব্য এবং ইতিহাস গ্রন্থে বর্ণিত হয় নি;কেবল উপরোক্ত দু’টি ইতিহাস গ্রন্থেই তা বর্ণিত হয়েছে। কখনও কখনও অধিকাংশ ইতিহাসবেত্তা কোন ঘটনা বর্ণনা না করলে এবং এতদ্প্রসঙ্গে অন্যান্য দলিল ও বিষয় যোগ করলে উক্ত ঘটনা যে বাস্তবে সংঘটিত হয় নি তা প্রমাণিত হয়ে যায়। এখানেও প্রকৃত বিষয় ঠিক এমনই। যেহেতু মহানবীর ওফাতের পরে খিলাফত এবং মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব থেকে হযরত আলীকে দূরে সরিয়ে রাখা হয় সে জন্য অন্যদের প্রশাসন আহলে বাইতের দৃষ্টিতে তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তাই আদেশ-নিষেধ জারীকরণ,নিয়োগ ও অপসারণ,যুদ্ধ ও সন্ধিস্থাপন এবং আরো অন্যান্য প্রশাসনিক কর্মতৎপরতা তাঁদের দৃষ্টিতে মোটেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। এ জন্যই এ সব রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে তাঁদের অংশগ্রহণ না করা ও অনুপস্থিত থাকা ছিল খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।

এ সব ঘটনা (অর্থাৎ খলীফা উসমানের আমলে বিভিন্ন যুদ্ধে ইমামদ্বযের অংশ গ্রহণ) বর্ণনা করা থেকে অধিকাংশ ঐতিহাসিক যে বিরত থেকেছেন তা আসলে ইমাম ভ্রাতৃদ্বয়ের উপরোক্ত যুদ্ধসমূহে অংশগ্রহণ না করার পক্ষে সবচেয়ে উত্তম দলিল। দু’একটি অনির্ভরযোগ্য হাদীস ও বর্ণনার মাধ্যমে উপরোক্ত বিষয়টি প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হয় না।

এ সব বর্ণনার চেয়ে আরো বেশি অনির্ভযোগ্য ও অবাস্তব রেওয়ায়েত ও হাদীস রয়েছে যেগুলোতে বর্ণিত হয়েছে যে,মুয়াবিয়ার শাসনামলে ইমাম হুসাইন (আ.) লম্পট ইয়াযীদ ইবনে মুয়াবিয়ার নেতৃত্বে কনস্টানটিনোপোল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। গবেষক,ঐতিহাসিক ও হাদীসবেত্তাগণ এ সব বর্ণনাকে অনির্ভরযোগ্য বলে বিবেচনা করেছেন এবং গ্রহণ করেন নি। সম্ভবত আহলে বাইতের নেতৃত্ব বিশেষ করে ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইনের নেতৃত্ব এবং কারবালায় ইমাম হুসাইন ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের হৃদয় বিদারক শাহাদাত বরণের ঘটনাকে অম্লান ও কম গুরুত্বপূর্ণ দেখানো এবং অন্যদিকে বনু উমাইয়্যার খলীফা নামধারী লম্পট রাজা-বাদশাদের নেতৃত্ব ও শাসন মুসলিম উম্মাহর কাছে ধর্মীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য ও বৈধ করার জন্যই এ সব রেওয়ায়েত ও হাদীস রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বেতনভুক উমাইয়্যাপন্থী মিথ্যাবাদী রাবীদের দ্বারা জাল করা হয়েছিল।

(চলবে)

 

তথ্যসূত্র

১. সুনানে ইবনে মাজাহ্,১ম খণ্ড,হাদীস নং ১৪৬,পৃ. ৯৩,ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত।

২. সুনানে ইবনে মাজাহ্,১ম খণ্ড,হাদীস নং ১৪৭,পৃ. ৯৩,ই. ফা. বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত।

৩. সুনানে ইবনে মাজাহ্ ১ম খণ্ড,হাদীস নং ১৪৮,পৃ. ৯৩,ই. ফা. বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত।

৪.“হে আম্মার! বিদ্রোহী দলটি তোমাকে হত্যা করবে” শীর্ষক হাদীসটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সাহাবী বর্ণনা করেছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন কাতাদাহ্ ইবনুন নোমান,উম্মে সালামাহ্ (সহীহ মুসলিমে),আবদুল্লাহ্ ইবনে আমর (নাসাঈ),উসমান ইবনে আফ্ফান,হুযাইফা,আবু আইউব,আবু রাফে,খুযাইমা ইবনে সাবেত,মুয়াবিয়া,আমর ইবনুল আস,আবুল ইউসর ও আম্মার (সকলের বর্ণনা তাবরানীতে) প্রমুখ সাহাবী (রা.)। এখানে বিদ্রোহী দলটি বলতে আমীর মুয়াবিয়া ও তাঁর দলকে বোঝানো হয়েছে। কারণ তারা বৈধ ইমামের বিরোধিতা করেন এবং ভ্রান্ত বক্তব্যের আশ্রয় নিয়ে তাঁর আনুগত্য পরিহার করেন। সহীহ বুখারীতে আবু সাঈদ আল-খুদরী (রা.) কর্তৃক বর্ণিত মসজিদে নববী নির্মাণ সম্পর্কিত হাদীসে আছে : “আমরা একটি করে ইট বহন করে নিয়ে যেতাম,আর আম্মার দু’টি করে ইট বহন করে নিত। নবী (সা.) তা দেখে আম্মার-এর চেহারা থেকে মাটি ঝেড়ে ফেলেন আর বলেন : হায় আম্মার বিদ্রোহী দলটি তাকে হত্যা করবে। সে তাদের জান্নাতের দিকে ডাকবে আর তারা তাকে দোযখের দিকে ডাকবে। উল্লেখ্য,হযরত আম্মার সিফ্ফিনের যুদ্ধে আমীর মুয়াবিয়ার বাহিনী কর্তৃক নিহত হন। (তুহফাতুল আহ্ওযায়ী,১০ম খণ্ড,পৃ. ৩০১) [জামে আত্-তিরমিযী,৬ষ্ঠ খণ্ড,পৃ. ৩৬৮-৩৬৯,হাদীস নং ৩৭৩৮,বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার ঢাকা কর্তৃক প্রকাশিত]

৫. সাদরুদ্দীন শারাফুদ্দীন প্রণীত আম্মার ইয়াসির (রা.) পৃষ্ঠা ২১৮-২২০,ইসলামিক সেমিনারী পাবলিকেশন্স,করাচী,পাকিস্তান কর্তৃক প্রকাশিত;আল্লামাহ্ বালাযুরী প্রণীত আনসাবুল আশরাফ,৫ম খণ্ড,পৃ. ৪৮;ইবনে আবদুল বার প্রণীত আল ইস্তিয়াব,২য় খণ্ড,পৃ. ৪২২;ইবনে কুতাইবাহ্ প্রণীত আল-ইমামাহ্ ওয়াস সিয়াসাহ্,১ম খণ্ড,পৃ. ২৯।

৬. আল্লামাহ্ বালাযুরী প্রণীত আনসাবুল আশরাফ,৫ম খণ্ড,পৃ. ৪৯;তারিখে ইয়াকূবী,২য় খণ্ড,পৃ. ১৪৭।

৭. উমর বিন শাব্বাহ্ প্রণীত তারীখুল মদীনাহ্,৩য় খণ্ড,পৃ. ৯৭৪;আবুল ফারাজ আল ইসফাহানী প্রণীত আল-আঘানী,৫ম খণ্ড,পৃ. ১৩৫।

৮. আয-যারকালী প্রণীত,আল-আ’লাম বৈরুত থেকে মুদ্রিত,৮ম খণ্ড,পৃ. ১১২,পার্শ্ব লিখনে মাসউদী থেকে বর্ণিত।

৯. মুহম্মদ আহসান উল্লাহ প্রণীত খিলাফতের ইতিহাস,মোহাম্মদ আবদুল জব্বার সিদ্দীকী কর্তৃক অনূদিত,পৃ. ৫৯-৬০,ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত।

১০. আয-যারকালী প্রণীত আল-আলাম,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৮৯;আল-হাকেমের মুস্তাদরাকুস সাহীহাইন,৩য় খণ্ড,পৃ. ১০০;ইবনে আসীর প্রণীত উসদুল গাবাহ্,৫ম খণ্ড,পৃ. ১৭৩;উক্ত আয়াতের তাফসীর আল-কাশশাফে আল-বালাযুরী প্রণীত আনসাবুল আশরাফ,৫ম খণ্ড,পৃ. ৪৯।

১১. ইবনে আবীল হাদীদ প্রণীত শারহু নাহজিল বালাগাহ্,১ম খণ্ড,পৃ. ১৯৯।

১২. আল-বালাযুরী প্রণীত আনসাবুল আশরাফ,৫ম খণ্ড,পৃ. ২৭।

১৩. মুহাম্মদ আহসান উল্লাহ প্রণীত খিলাফতের ইতিহাস,মোহাম্মদ আবদুল জব্বার সিদ্দীকী কর্তৃক অনূদিত,পৃ. ৬৫-৬৬,ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত।

১৪. ইবনে হিশাম প্রণীত সীরাহ্,৪র্থ খণ্ড।

১৫. আল-আমীনী প্রণীত আল-গাদীর,১০ম খণ্ড,পৃ. ১৭৯।

১৬. আল-আমীনী প্রণীত আল-গাদীর,১০ম খণ্ড,পৃ. ১৭৯;তারীখে ইবনে কাসীর,৭ম খণ্ড,পৃ. ২১১।

১৭.মুহম্মদ আহসান উল্লাহ প্রণীত খিলাফতের ইতিহাস,পৃ. ৭৭-৮৩,ইসলামিক ফাউণ্ডেশন,বাংলাদেশ ঢাকা কর্তৃক হিজরী ১৪০০ বার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে প্রকাশিত।

১৮. আল্লামাহ্ বালাযুরী প্রণীত আল আনসাব,৫ম খণ্ড,পৃ. ৮১;ইকদুল ফারীদ,৩য় খণ্ড পৃ. ২৯৬।

১৯. বালাযুরীর আল-আনসাব,৫ম খণ্ড,পৃ. ৯০।

২০. আল গাদীর,৯ম খণ্ড,পৃ. ৯৭-৯৮।

২১. মুহম্মদ আহসান উল্লাহ প্রণীত খিলাফতের ইতিহাস,পৃ. ৮৬-৮৭,ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক ১৯৮০ সালে প্রকাশিত।

২২. মুহম্মদ আহসান উল্লাহ প্রণীত খিলাফতের ইতিহাস,পৃ. ৮৫,ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক ১৯৮০ সালে প্রকাশিত।

২৩. আল-গাদীর,৯ম খণ্ড,পৃ. ১৩৫-১৩৯ ও ১৪৯-১৫২।

২৪. আল-গাদীর,৯ম খণ্ড,পৃ. ১৪৯-১৫২।

২৫. নাহজুল বালাগাহ্,খুতবা নং ৩০।

২৬. নাহজুল বালাগাহ্,খুতবা নং ২৩৮।

২৭. আল্লামাহ্ বালাযুরী প্রণীতআনসাবুল আশরাফ,৫ম খণ্ড,পৃ. ১০১।

২৮. ড. ত্বাহা হুসাইন প্রণীত আল ফিতনাতুল কুবরা,২য় খণ্ড,পৃ. ১৯৩-১৯৪।

২৯. তারিখে তাবারী,৫ম খণ্ড,পৃ. ৫৭-৫৮;ইবনে খালদুন প্রণীত কিতাবুল ইবার,২য় খণ্ড,

পৃ. ১২৮-১৩৫।

(সূত্র: জ্যোতি,২য় বর্ষ,১ম সংখ্যা)

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

যদি কেউ দাড়ি না রাখে তাহলে সে কি ...
পবিত্র ঈদে গাদীর
দাওয়াতে দ্বীনের গুরুত্ব ও ...
কারবালা ও ইমাম হোসাইন (আ.)- ১ম পর্ব
ইমাম মাহদী (আ.) এর আবির্ভাবের ৬ মাস ...
হাসনাইন (ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন) ...
মসনবীর গল্প
অর্থসহ মাহে রমজানের ৩০ রোজার দোয়া
ইমাম হাসান আসকারী (আ.) এর জন্ম ...
সমাজ কল্যাণে আল-কুরআনের ভূমিকা

 
user comment