বাঙ্গালী
Saturday 20th of April 2024
0
نفر 0

সূরা ইউনুস;(১২তম পর্ব)



সূরা ইউনুস; আয়াত ৫৭-৬১

সূরা ইউনুসের ৫৭ ও ৫৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন

يَا أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَتْكُمْ مَوْعِظَةٌ مِنْ رَبِّكُمْ وَشِفَاءٌ لِمَا فِي الصُّدُورِ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِلْمُؤْمِنِينَ (57) قُلْ بِفَضْلِ اللَّهِ وَبِرَحْمَتِهِ فَبِذَلِكَ فَلْيَفْرَحُوا هُوَ خَيْرٌ مِمَّا يَجْمَعُونَ

"হে মানুষ! তোমাদের জন্য তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তোমাদের অন্তরের রোগ-ব্যাধি নিরাময় তথা সব মুমিনের জন্যে আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে হেদায়াত বা পথনির্দেশনা।” (১০:৫৭)

“(হে রাসূল! আপনি মুমিনদেরকে) বলে দিন, তারা যেন কেবল আল্লাহর অনুগ্রহ এবং দয়াতেই আনন্দিত হয়। কেননা- তারা যা জমায়, তার চেয়ে এটাই তাদের জন্যে শ্রেয়।" (১০:৫৮)

মানুষের অন্তর মানুষের দেহের মতোই বিভিন্ন রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। তাই দেহের মতো অন্তরেরও প্রতিষেধক তথা নিরাময় প্রয়োজন। গর্ব-অহঙ্কার, হিংসা-বিদ্বেষ এবং রিয়ার মতো অন্তরের রোগ-ব্যাধিগুলোর চিকিতসা করা না হলে ওই অন্তরে কুফরি এবং মোনাফেকি বাসা বাঁধে। আর এই কুফরি মানুষকে হেদায়েতের পথ থেকে বিচ্যুত করে দেয়। কিন্তু কুরআনের বিভিন্ন রকম বক্তব্য, সুসংবাদ এবং সাবধানবাণী বেশিরভাগ গুনাহ বা পাপকাজ থেকে মানুষকে ফিরিয়ে রাখার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অন্যদিকে পাপ কাজের জন্যে যে পরকালে আল্লাহর শাস্তি ভোগ করতে হবে সে কথা বলে কুরআন মানুষকে সচেতন করে দিচ্ছে, যাতে তাদের অন্তরগুলো পবিত্র হয়ে যায়। আর পূত-পবিত্র অন্তরে যে আল্লাহর রহমত ও হেদায়াত লাভ করার ক্ষেত্র তৈরি হবে সেটাই তো স্বাভাবিক। এজন্যেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর প্রিয় রাসূলকে নির্দেশ দিয়েছেন, তিনি যেন মানুষকে এটা জানিয়ে দেন যে, তাদের সর্বোতকৃষ্ট পুঁজি হচ্ছে ঐশীগ্রন্থের প্রতি ঈমান আনা এবং তার যথাযথ অনুসরণ করা। অন্য কোনো সঞ্চয় বা খ্যাতির জন্যে আনন্দিত না হয়ে বরং এই বৃহত নেয়ামতের জন্যেই তাদের আন্তরিক প্রশান্তি লাভ করা উচিত।

এই দুই আয়াত থেকে আমাদের জন্যে শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো :

এক. অন্তরের সব ধরনের ব্যাধির সর্বোতকৃষ্ট প্রতিষেধক হলো আল-কুরআন।

দুই. দুঃখ-কষ্ট, ব্যক্তিগত কিংবা সামাজিক যে কোনো সমস্যা সমাধানের উপায় কুরআন থেকেই শিখতে হবে, অন্য কোনো মানব রচিত মতবাদ থেকে নয়।

তিন. কুরআন হলো পার্থিব জগতের সব ধরনের ধন-সম্পদের চেয়েও মূল্যবান ও শ্রেষ্ঠ। সেই ব্যক্তি প্রকৃত দুর্ভাগা-যে পার্থিব সব সম্পদের অধিকারী হয়েও কুরআনের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। পক্ষান্তরে সে-ই প্রকৃত ধনী যিনি পার্থিব জীবনে অর্থ-সম্পদহীন হয়েও কুরআনের আদর্শ অনুযায়ী জীবনযাপন করেন।

সূরা ইউনুসের ৫৯ এবং ৬০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,

قُلْ أَرَأَيْتُمْ مَا أَنْزَلَ اللَّهُ لَكُمْ مِنْ رِزْقٍ فَجَعَلْتُمْ مِنْهُ حَرَامًا وَحَلَالًا قُلْ آَللَّهُ أَذِنَ لَكُمْ أَمْ عَلَى اللَّهِ تَفْتَرُونَ (59) وَمَا ظَنُّ الَّذِينَ يَفْتَرُونَ عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِنَّ اللَّهَ لَذُو فَضْلٍ عَلَى النَّاسِ وَلَكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لَا يَشْكُرُونَ

"বলুন! তোমরা কি এটা লক্ষ্য করেছো, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তোমাদের জন্য যেসব জীবনোপকরণ দান করেছেন, তার মধ্য থেকে তোমরা কিছু অংশকে হালাল করেছো আবার কিছু অংশকে হারাম করেছো? আল্লাহ কি তোমাদেরকে এ কাজের অনুমতি দিয়েছেন, নাকি তোমরা আল্লাহর ওপর মিথ্যা আরোপ করেছো?” (১০:৫৯)

"যারা আল্লাহর ওপর মিথ্যা আরোপ করে, শেষ বিচারের দিন সম্পর্কে তাদের কি ধারণা রয়েছে? অবশ্য আল্লাহ সব মানুষের প্রতি অনুগ্রহপরায়ণ ও ক্ষমাশীল কিন্তু অনেকেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না।" (১০:৬০)

আগের দু'টি আয়াতে কুরআনের রহমত ও হেদায়াতের কথা বলা হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় এই আয়াতগুলোতে বলা হচ্ছে, যারা কুরআন থেকে দূরে থাকে, কুসংস্কারের ফাঁদে এবং ভিত্তিহীন ও নিজেদের তৈরি নিয়ম-নীতির ফাঁদে তারা আটকা পড়ে যায়- এই ফাঁদই তাদের জীবনকে কঠিন ও সমস্যা সঙ্কুল করে তোলে। কুরআনের অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, মুশরিকরা বিভিন্ন কৃষিপণ্য এবং চতুষ্পদ প্রাণীকে নিজেরাই নিজেদের জন্যে হারাম ঘোষণা করে সেগুলোকে মূর্তিপূজা ও মন্দিরে বলি দিতো। অথচ কুরআন বলছে, তোমাদের রুটি-রুযি বা জীবনোপকরণগুলো আল্লাহর পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে, ফলে কোনটি হালাল আর কোনটি হারাম, তা বলার অধিকার তিনিই রাখেন; তোমরা নও। তবে হ্যাঁ, আল্লাহ যদি তোমাদেরকে এই কাজের অনুমতি দিয়ে থাকেন, সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু তিনি তো তোমাদের অনুমতি দেননি, ফলে তাঁর ওপর মিথ্যা আরোপের ব্যাপারে কিয়ামতের দিন অবশ্যই জবাবদিহী করতে হবে।

অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, মানুষের প্রতি আল্লাহ যেসব নেয়ামত দান করেছেন, তা আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়ারই প্রমাণ বহন করে। কিন্তু তারা আল্লাহর এইসব নিয়ামত বা অনুগ্রহের ব্যাপারে কোনরকম শোকর বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না। বরং অযৌক্তিক কিছু কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে নিজেদেরকে আল্লাহর এই নিয়ামত থেকে বঞ্চিত রাখছে।

এই দুই আয়াত থেকে আমাদের জন্যে শিক্ষণীয় হলো :

এক. নিয়ামতসমূহের মালিক একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। একমাত্র তিনিই এগুলোকে হালাল কিংবা হারাম ঘোষণা করার অধিকার রাখেন। কোনো মানুষই তাদের ইচ্ছেমতো এগুলোকে হালাল কিংবা হারাম ঘোষণা করার অধিকার রাখে না।

দুই. শরীয়তের বিধি-বিধান অর্থাত আইন প্রণয়নের অধিকার একমাত্র আল্লাহর। তাঁর বিধি-বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক সব আইনই বেদআত এবং অগ্রহণযোগ্য।

সূরা ইউনুসের ৬১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,

وَمَا تَكُونُ فِي شَأْنٍ وَمَا تَتْلُو مِنْهُ مِنْ قُرْآَنٍ وَلَا تَعْمَلُونَ مِنْ عَمَلٍ إِلَّا كُنَّا عَلَيْكُمْ شُهُودًا إِذْ تُفِيضُونَ فِيهِ وَمَا يَعْزُبُ عَنْ رَبِّكَ مِنْ مِثْقَالِ ذَرَّةٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي السَّمَاءِ وَلَا أَصْغَرَ مِنْ ذَلِكَ وَلَا أَكْبَرَ إِلَّا فِي كِتَابٍ مُبِينٍ

"তুমি যখন কোন কাজে রত হও এবং কুরআন থেকে কোন কিছু তেলাওয়াত কর এবং তোমরা যে কোনো কাজ কর, যখন তোমরা তাতে প্রবৃত্ত হও (তখন) আমি তোমাদের পরিদর্শক। আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর অণু পরিমাণও তোমার প্রতিপালকের অগোচর নয় এবং এর চেয়ে ক্ষুদ্রতর অথবা বৃহত্তর কিছুই নেই যা সুষ্পষ্ট গ্রন্থে উল্লেখ নেই।" (১০:৬১)

এই আয়াতে আল্লাহর অসীম জ্ঞানের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। তিনি যে মানুষের সব অবস্থা ও কাজ-কর্ম সম্পর্কে অবহিত এবং পৃথিবীর অণু পরিমাণ বা তার চেয়ে ক্ষুদ্রতর জিনিসও যে তার দৃষ্টিসীমার মধ্যে-এই আয়াতে সে সম্পর্কেই কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া, সব কিছুই লওহে মাহফুজে নিবন্ধিত হচ্ছে, কাজেই আল্লাহ ছাড়া তার ফেরেশতাগণও মানুষের কাজ-কর্ম প্রত্যক্ষ করছেন এবং তারা যা কিছু দেখছেন, তা লিখে রাখছেন ও সংরক্ষণ করছেন।

সূরা ইউনুসের ৬১ নম্বর আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :

এক. আমাদের কাজ-কর্ম, কথা-বার্তা এমনকি আমরা যা চিন্তা করছি, তার সবকিছুই আল্লাহ ও তার ফেরেশতারা দেখছেন এবং আমাদের কোনো কিছুই তার কাছে গোপনীয় নয়।

দুই. আল্লাহর কাছে আকাশ-ভূমি, ক্ষুদ্র-বৃহত; এসবের কোন পার্থক্য নেই, তার অস্তিত্ব সর্বত্র এবং সবকিছুই তার জ্ঞানের পরিধির আওতায়।

তিন. শুধু সাধারণ মানুষই নয় নবী-রাসূলদের ওপরও আল্লাহ নজর রেখেছেন এবং তাদের কাজ-কর্ম প্রত্যক্ষ করেছেন।

চার. গোটা বিশ্বই আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন। ফলে, আমাদের কাজের জন্য ততক্ষনাত শাস্তি না পাওয়ার অর্থ এই নয় যে, তিনি আমাদের কৃতকর্মের ব্যাপারে অবহিত নন বা আমাদের কাজ সম্পর্কে তিনি উদাসীন বরং তা আমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ-যাতে আমরা তওবা করে সঠিক পথে ফিরে যেতে পারি।

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

অবিকৃত গ্রন্থ আল-কোরআন
ইমাম রেজা (আ.)'র কয়েকটি অলৌকিক ঘটনা
কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনা : একটি ...
Protest einer Antikriegsgruppe gegen Luftangriff Amerikas auf ein Krankenhaus
খলিফা নির্বাচনের পদ্ধতি
‘বাতিলের মুকাবিলায় ঐক্যই ...
অর্থসহ মাহে রমজানের ৩০ রোজার দোয়া
কোরআন ও চিকিৎসা বিজ্ঞান
শিয়াদের মৌলিক বিশ্বাস (পর্ব-১)
সূরা ইউনুস;(১৭তম পর্ব)

 
user comment