বাঙ্গালী
Friday 29th of March 2024
0
نفر 0

হযরত আলী (আ.)-এর শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষে আয়াতুল্লাহ্ আল উযমা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী প্রদত্ত ভাষণ

হযরত আলী (আ.)-এর শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষে আয়াতুল্লাহ্ আল উযমা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী প্রদত্ত ভাষণ

আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন। নাহমাদুহু ওয়া নাসতায়িনুহু ও নাসতাহদিহী ওয়া নুমিনুবিহী ওয়া নাসতাগফিরুহু ওয়া নাতাওয়াক্কালু আলাইহী ওয়া নুসাল্লি ওয়া নুসাল্লিম আলা হাবীবিহী ওয়া নাজিবিহী ওয়া খিয়ারাতিহী ফি খালকিহী ওয়া হাফিজি সিররিহী ওয়া মুবাল্লিগি রিসালাতিহী সাইয়্যিদিনা ওয়া নাবিয়্যিনা আবিল কাসিম মুস্তাফা মুহাম্মদ (সা.) ওয়া আলিহী তাইয়্যিবিনা আনজাবিন আল আইম্মাতিল হুদাতিল মাহদিয়্যিন সিইয়ামা বাকিয়াতাল্লাহি ফিল আরাদিন ওয়া সাল্লি আলা আইম্মাতিল মুসলিমীন ওয়া হুমাতুল মুসতাদআফিন ওয়া হুদাতুল মুমিনীন।

নামাজে আগত ভাই-বোনদের এবং নিজেকে তাকওয়ার দিকে আহ্বান করছি। জুমআর এ প্রথম খুতবায় মন-প্রাণ দিয়ে তাকওয়াকে অবলম্বন করার সিদ্ধান্ত নিন। রমযান মাসের রোযা ও এর পবিত্র ও আধ্যাত্মিক পরিবেশের সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে এই মহান বৈশিষ্ট্য অর্জনের প্রচেষ্টা চালান যাতে করে প্রকৃত অর্থেই আমরা মুত্তাকী ও পরহেজগার হতে পারি।

২১ রমজানের আজকের এ দিনটি শবে কদরের দিন হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। আজকের দিনটি আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)-এর শাহাদাতের দিনও বটে। বছরের শ্রেষ্ঠ তিন রাত্রির এক রাত্রি ছিল গত রাত। শবে কদরের সম্ভাব্য তিন রাত্রির একটি হলো এটি। এ রাত্রিগুলোর একটিতেই ফেরেশতাদের আগমন ঘটেছিল বা ঘটবে। সৌভাগ্য তাদের জন্য যারা ফেরেশতাদের আগমনের সাথে নিজেদেরকে ফেরেশতাদের গুণে গুণান্বিত করতে পেরেছেন।

تنزل الملائكة و الرّوح فيها بإذن ربّهم من كلّ أمر এ আয়াতে যে ফেরেশতাদের আগমনের কথা বলা হয়েছে এ আগমন যেন আমাদেরকে ফেরেশতার গুণে গুণান্বিত হতে সাহায্য করে। নিশ্চিতভাবে আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন যাঁরা গত রাত্রিটি খুব ভালোভাবে কাটিয়েছেন এবং হৃদয় ও অন্তর্চক্ষু দিয়ে শবে কদরকে অনুভব করেছেন। কেউ কেউ হয়তো ঊনিশ ও একুশের রাত দু’টি ভালোভাবে কাটিয়েছেন এবং তেইশে রমজানের রাতটিও ইনশাআল্লাহ্ সুন্দরভাবে কাটাবেন। আমরা লক্ষ্য করেছি এ দেশের প্রতিটি মুসলিম নর-নারী,তরুণ-তরুণী এ রাত্রিগুলোতে প্রকৃতই নিজেদের অন্তরকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করার সংকল্প নিয়ে থাকেন,তাঁদের হৃদয়সমূহ কোমল,চক্ষুসমূহ অশ্রুসিক্ত আর আত্মা খোদাপ্রেমে বিগলিত। এ ক্ষেত্রে রোযা তাঁদের সাহায্য করেছে। আমাদের অবশ্যই আশাবাদী হওয়া উচিত এবং দোয়া করা উচিত যাতে এ রাতগুলোর সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করতে পারি এবং আত্মিক উন্নয়ন ঘটাতে পারি। নামাজ যেমনভাবে মুমিনের মিরাজ,দোয়া ও শবে কদরও তেমনি মুমিনদের মিরাজ ও ঊর্ধ্বগমনের পথ। আমাদের এমন কাজ করা উচিত যাতে আত্মিক উন্নয়ন ঘটে। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ যে বস্তুর মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে রয়েছে আমাদেরকে তা থেকে মুক্ত থাকার চেষ্টা করতে হবে। অতি লোভ,দুনিয়ার প্রতি আসক্তি,বদমেজাজ,রূঢ়তা,অমানবিক ও মানবতাবিরোধী আচরণ,আগ্রাসন,সীমা লঙ্ঘন,বিশৃঙ্খলা,অশ্লীলতা,অন্যায়,অবিচার,জুলুম প্রভৃতি মানুষের আত্মিক আবর্জনা। এ রাতগুলোর সাহায্যে যেন আমরা নিজেদের এ সব হতে দূরে রাখতে পারি। শবে কদর আমাদের জন্য এ সফলতা বয়ে আনুক।

আজকে আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)-এর শাহাদাত সম্পর্কে বলতে চাই। এ শাহাদাত শুধু কালের প্রবাহে ঘটে যাওয়া একটি শোকার্ত ঘটনাই নয় যে,আমরা তা স্মরণ করে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে দায়িত্ব সম্পন্ন করতে পারি;বরং এ শোকার্ত ঘটনা কালের সার্বক্ষণিক শোক। কারণ,হযরত আলী (আ.)-এর শাহাদাত শুধু কালের একটি নির্দিষ্ট সময়ে মানবতার জন্য ক্ষতি ডেকে আনেনি,বরং মানব জাতির সমগ্র ইতিহাসে চরম ক্ষতি সাধন করেছে।

أن تهدّمت و الله أركان الهدى “আল্লাহর শপথ,হেদায়েতের স্তম্ভ ভূলুণ্ঠিত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।” অপূরণীয় এ ক্ষতির ভবিষ্যদ্বাণী এ ঘটনার ২৫ বছর পূর্বে হযরত ফাতিমা যাহরা (আ.) তাঁর অসুস্থাবস্থায় মদীনার মহিলাদের উদ্দেশে বলেছিলেন। আর আলী (আ.)-কে যদি প্রকৃত অধিকার দেয়া হতো (রাসূলের নির্দেশানুযায়ী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ),তবে এ বিশ্বের অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে যেত। সিদ্দীকাতুত তাহিরা হযরত ফাতিমা যাহরা (আ.)-এর ভাষায় :

(لسار بهم سيرا سجحا) তাদের জীবন চলার পথকে তাদের জন্য মসৃণ ও সহজ করে দিত।

(لا يكلم خشاشه) ইসলামী সমাজের দেহে ক্ষুদ্রতম আঁচরও পড়তে দিত না। আমার ভাষায় : ইসলামী শাসন-ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতেন ও ইসলামী রাষ্ট্রকে ক্ষতির হাত থেকে মুক্ত রাখতেন। রাষ্ট্র পরিচালনার সর্বোত্তম ধরন হলো এর কাঠামোতে যেন কোন আঘাত না লাগে,জনগণ সাবলীলভাবে জীবনের (বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক) উন্নয়নের পথে কাজ করতে পারে।

و لا يكل سائره و لا يمل راكبه و لأوردهم منهلا نميرا صافيا رويا (কাফেলার নেতারও এতে কষ্ট হতো না,যাত্রীরাও পরিশ্রান্ত হতো না;তাদের অফুরন্ত সুপেয় পানির এক উৎসে পৌঁছে দিত যা কখনই কলুষিত হওয়ার নয়)- এ কথাগুলো হযরত ফাতিমা (আ.) যেরূপ বলেছেন সেরূপই হতো। যা হোক এ সুযোগ রাসূল (সা.)-এর ওফাতের পঁচিশ বছর পর আসলো। দেরীতে হলেও অবশেষে মুসলমান সমাজ সমবেতভাবে আলী (আ.)-কে দায়িত্ব দিল। হযরত আলীর শাসনের সময়কাল ৩৫ হিজরীর জিলহজ্ব মাস হলে ৪০ হিজরীর রমজান পর্যন্ত মোট চার বছর দশ মাস- যা খুবই কম সময়। কিন্তু এ স্বল্প সময়েই তিনি অনেকগুলো বড় কাজ করেছেন এবং গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাজের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। যদি ইবনে মুলজিমের অপরাধ,বিশ্বাসঘাতক তরবারি ও পর্দার অন্তরালের গোপন তৎপরতা (মুয়াবিয়া ও আমর ইবনুল আস চক্রের) না থাকত,তাহলে আমীরুল মুমিনীনের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকত এবং সম্ভবত কয়েক শতাব্দীব্যাপী মুসলিম-বিশ্ব ও ইসলাম নিশ্চিত নিরাপত্তা পেত ও বীমা লাভ করত।

তাই এদিনে যে শোক আপতিত হয়েছে তা ইসলামী বিশ্ব ও ইসলামের ইতিহাসকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। দ্বিতীয়বারের মতো এক পবিত্র উৎস-যার পরিশুদ্ধ সুপেয় পানি হতে ইসলামী বিশ্ব তৃষ্ণা নিরারণ করতে পারত তা তাদের হাতছাড়া হলো। তাই এ শোক সর্বকালের জন্য। আমীরুল মুমিনীন এ সংক্ষিপ্ত সময়ে যে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেছেন তা এক কথায় বর্ণনা করে এ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা রাখব।

আমীরুল মুমিনীন এ সময়টিতে দেখিয়ে দেন ইসলামের মৌলনীতি ও মূল্যবোধ যা ইসলামের কোণঠাসা অবস্থায়ও ক্ষুদ্র ইসলামী সমাজে বাস্তবায়িত হয়েছিল-তা ইসলামের প্রসারিত,সমৃদ্ধ,পার্থিব উৎকর্ষ ও শক্তিধর অবস্থানের সময়ও বাস্তব রূপ দেয়া সম্ভব। লক্ষ্য করুন,এ বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের আজকের সমাজেও এ বিষয়টি লক্ষ্যণীয়। ইসলামের মৌলনীতি,ইসলামের ন্যায়ের ধারণা,মানুষের মর্যাদা,বিপ্লবী মানসিকতা,পুনর্গঠন,মূল্যবোধ,নৈতিকতার ভিত্তি যা মহানবী (সা.)-এর জীবদ্দশায় ঐশী প্রত্যাদেশ হিসাবে এসেছে তিনি তাঁর সাধ্যমতো মদীনার ইসলামী সমাজে তা বাস্তবায়ন করেছেন। তখন মদীনা কয়েক হাজার মানুষ অধ্যুষিত ক্ষুদ্র এক শহর। এরপর যখন মক্কা বিজিত হলো,তায়েফ মুসলমানদের নিকট পদানত হলো তখনও মুসলিম সমাজ ছিল সীমিত,তাদের সুযোগ-সুবিধাও ছিল সীমিত;দারিদ্র্য তখনও সর্বত্র বিরাজমান ছিল। এ রকম এক পরিবেশেই ইসলামের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল।

এরপর পঁচিশ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। মহানবী (সা.)-এর ওফাতের পঁচিশ বছর পর ইসলামী রাষ্ট্রের পরিধি শুধু দুই,তিন বা দশগুণ নয়;বরং কয়েক শত গুণ বেড়েছে। যেদিন হযরত আলী (আ.) ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব পান সেদিন এর পরিধি মধ্য এশিয়া হতে উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তৃত (অর্থাৎ আজারবাইজান হতে মিশর) ছিল। ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিবেশী দু’বৃহৎ শক্তি ইরান ও রোম সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। তৎকালীন ইরানের সমগ্র ভূমি মুসলমানদের কাছে পদানত হয়েছিল। আর রোমের অধিকাংশ স্থান,যেমন বৃহত্তর সিরিয়া,বৃহত্তর ফিলিস্তিন ও তৎসংলগ্ন এলাকা মুসলিম শাসনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পূর্বের দারিদ্র্য,মন্দা,খাদ্যাভাব আর ছিল না। স্বর্ণ,রৌপ্য,অর্থ-সম্পদ আর প্রাচুর্য সর্বব্যাপী হয়েছিল। ফলশ্রুতিতে ইসলামী রাষ্ট্র সম্পদশালী এক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল এবং জনগণ অর্থনৈতিক সচ্ছলতা লাভ করেছিল। কেউ কেউ প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদের অধিকারী হয়েছিল। যদি আমরা ইতিহাস হতে হযরত আলীকে বাদ দিই তবে হয়তো ইতিহাস এভাবে পর্যালোচনা করত যে,মহানবী (সা.)-এর শিক্ষা,ইসলামী মৌলনীতি ও মূল্যবোধ- এ বিষয়গুলো মহানবীর জীবদ্দশায় মদীনার প্রেক্ষাপটেই প্রযোজ্য ছিল। এ মহান শিক্ষা ক্ষুদ্র মুসলিম সমাজ- যাতে দারিদ্র্য বিদ্যমান তারই উপযোগী- এর অধিক নয়।

পরবর্তীতে যখন ইসলামী সমাজ বিস্তৃত হলো,অন্য সভ্যতার সঙ্গে মিশ্রিত হলো তখন অন্যান্য সভ্যতা,বিশেষত রোমীয় ও ইরানী সভ্যতা জনগণের জীবনে প্রভাব রাখতে লাগল। যখন অন্যান্য জাতি ইসলামী সমাজের ছায়ায় আসলো তখন পূর্বোক্ত মৌলনীতি এ সমাজের জন্য যথেষ্ট বলে বিবেচিত হয়নি। কেউ কেউ ভাবতে পারতেন,ইসলামের মৌলনীতি এরূপ সমাজকে পরিচালনে সক্ষম নয়। হযরত আলী (আ.) তাঁর পাঁচ বছরের শাসনকালে তাঁর কর্ম,জীবনপদ্ধতি ও শাসনপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে,ইসলামের প্রাথমিক যুগের সেই মৌলনীতি : তাওহীদ,ন্যায়বিচার,সাম্য,ইনসাফ,মানবাধিকার ও দৃঢ়তা পরিবর্তিত ও বিস্তৃত এক সমাজেও শক্তিশালী শাসকের যোগ্যতায় বাস্তবায়ন সম্ভব। ইতিহাসে তাঁর এ ভূমিকা লিপিবদ্ধ হয়েছে। তাঁর মৃত্যুর পর এ প্রক্রিয়া আর অব্যাহত থাকেনি,তা স্পষ্ট। কিন্তু আমীরুল মুমিনীন প্রমাণ করেছেন যে,যদি ইসলামী রাষ্ট্রের শাসক,পরিচালক ও সমাজনেতারা সিদ্ধান্ত নেন,দৃঢ় বিশ্বাস রাখেন এবং এগিয়ে আসেন তবে ইসলামের প্রাথমিক সময়ের সেই একই মূলনীতি ও জীবনপদ্ধতি প্রসারিত,পরিবর্তিত ও নতুন এক সমাজেও বাস্তবায়ন করা সম্ভব এবং সেই মৌলনীতির সুবিধা জনগণের দুয়ারে পৌঁছানো সম্ভব। এ বিষয়টি আমাদের আজকের সমাজে লক্ষ্য রাখতে হবে।

কেউ কেউ ভাবেন বিপ্লব,জিহাদ,সামাজিক ন্যায়বিচার,ধর্ম,স্বাধীনতা,আত্মনির্ভরশীলতার যে স্লোগান ইরান জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছিল,মাঠে নামিয়ে ছিল,তাগুতী শক্তি শাহের পতন ঘটিয়েছিল,আট বছর যুদ্ধে প্রতিরোধের প্রেরণা যুগিয়েছিল আজ সে স্লোগান পুরানো হয়ে গিয়েছে এবং বাস্তবায়নযোগ্যতা হারিয়েছে।

না,এমনটি নয়। আমরা পুরানো হয়ে যেতে পারি,আমরা আমাদের শক্তিমত্তা ও দৃঢ়তা হারাতে পারি,আমরা দুর্বল হতে পারি,কিন্তু সেই মূলনীতি পূর্বের মতোই শক্তিমত্তা ও দৃঢ়তার সাথে টিকে রয়েছে। যদি আমরা সঠিক ঈমান,পর্যাপ্ত যোগ্যতা,আশা ও উদ্দীপনা নিয়ে এগিয়ে যাই,শত্রুদের রাজনীতি ও প্রচারণার মিথ্যা ও প্রতারণার জালে জড়িয়ে না পড়ি ও বিভ্রান্ত না হই,তবে আজকে আমরা ঐ মৌলনীতিসমূহের আরো উজ্জ্বল প্রকাশ ঘটাতে পারব।

এটি স্পষ্ট যে,মদীনার পনের-বিশ হাজার লোকের এক সমাজে সামাজিক ন্যায়বিচার ও সাম্য প্রতিষ্ঠার সঙ্গে হযরত আলীর সময়ের কয়েক কোটি মানুষের সমাজে সাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার বিস্তর ব্যবধান রয়েছে। হযরত আলী (আ.) এরূপ সমাজ প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন এবং বাস্তবে তা দেখিয়েছেনও বটে। এখানে আমি আমীরুল মুমিনীনের কয়েকটি উদ্ধৃতি ও পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করব যা তাঁর জীবনের সহস্র নমুনার এক ক্ষুদ্র অংশ। (খলীফা উসমানের মৃত্যুর পর) মদীনার প্রসিদ্ধ ব্যক্তিরা,প্রথম শ্রেণীর সাহাবিগণ,গোত্রপতিগণ,ছোট-বড় সকলেই তাঁর নিকট এসে খেলাফতের পদ গ্রহণের জন্য পুনঃপুন আবেদন জানাতে লাগল এবং বলল,একমাত্র আলী ইবনে আবি তালিবই খেলাফতের যোগ্য। তাদের পীড়াপীড়ি লক্ষ্য করে তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। তাদের হতে বাইয়াত গ্রহণের জন্য সকলকে মসজিদে সমবেত হওয়ার নির্দেশ দিলেন। মসজিদে পৌঁছৈ মিম্বারে উঠলে সকলে বাইয়াত করল। খেলাফতে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রথম খুতবায় তিনি তাঁর নিজের কথাগুলো বললেন। তাঁর বক্তব্যের মধ্যে এ কথাগুলো ছিল : “আজ পর্যন্ত যে সকল সম্পদ অবৈধভাবে তথাকথিত স্বনামধন্য ব্যক্তিরা হস্তগত করেছে ও ভোগ করছে সেগুলো নিয়ে বাইতুল মালে ফিরিয়ে দিব। অনেকেই বছরের পর বছর ধরে বাইতুল মাল হতে সম্পদ হস্তগত করেছে। বিভিন্ন কলাকৌশলে তারা এগুলো হস্তগত করেছে। এখন তাদেরকে তা ফিরিয়ে দিতে হবে যদি তা দ্বারা তারা তাদের স্ত্রীদের মোহরানাও দিয়ে থাকে, যদি সে অর্থ দিয়ে দাসী ক্রয় করে থাকে (لو وجدته قد تزوج بها النّساء) তাও বাইতুল মালে ফিরিয়ে আনব। সকলেই জেনে রাখুক,এটিই আমার পদ্ধতি,যদিও কেউ তা পছন্দ না করে।”

কয়েক দিন পর থেকেই আপত্তি উত্থাপন ও প্রতিবাদ শুরু হলো। যাদের উদ্দেশে বলা হয়েছে,স্বাভাবিকভাবেই তারা অসন্তুষ্ট হয়েছিল। তারা গোপন সভা বসিয়ে বলতে লাগল : আলী এ কি কাজ করতে যাচ্ছে? তাদের একজন হলো উসমানের সময়ের কুফার গভর্নর ওয়ালিদ ইবনে ওকবা। সে হযরত আলী (আ.)-এর নিকট এসে বলল : “হে আলী! আমরা শর্তসাপেক্ষে তোমার হাতে বাইয়াত করতে পারি। শর্ত হলো : (أن تضع اناما اصبناه من المال في أيام العثمان) উসমানের সময় আমরা যে অর্থ ও সম্পদ লাভ করেছি,তা আমাদেরই থাকবে,তুমি তা ফিরিয়ে নিতে পারবে না।”

ওয়ালিদের পর তালহা ও যুবাইর প্রায় একই রকম প্রস্তাব নিয়ে আসলেন। যদিও ওয়ালিদ এবং তালহা ও যুবাইরের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য ছিল। ওয়ালিদ এক নও মুসলিম,তার পরিবার ছিল ইসলামবিরোধী,ইসলামের সঙ্গে তারা যুদ্ধ করেছে। যখন ইসলাম তাদের ওপর বিজয়ী হয়েছিল তখন বনি উমাইয়্যার অন্যান্য সদস্যের সাথে সেও ইসলাম গ্রহণ করেছিল। রাসূলের জীবনের শেষ দিকে তারা মুসলমান হয়েছিল। কিন্তু তালহা ও যুবাইর প্রাথমিক যুগের মুসলমান। তাঁরা রাসূল (সা.)-এর নিকটতম ও প্রসিদ্ধ সাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তাঁরাও আলীর নিকট এসে ক্ষোভ ব্যক্ত করে বললেন : “তুমি বাইতুল মালের অংশে অন্যদের সঙ্গে আমাদেরকে এক পর্যায়ে ফেলছ (أنك جعلتنا في القسم بغير حقنا)।... যারা আমাদের সমপর্যায়ে নয়,বাইতুল মালে তারা আমাদের সমকক্ষ হবে- এ কেমন কথা (و سويت بيننا و بين من لا يماثلنا)? কেন আমাদের শ্রেষ্ঠত্বকে মেনে নিচ্ছ না? আমাদের তরবারিতে বিজয় এসেছে,আমাদের কারণে ইসলাম এ পর্যায়ে পৌঁছেছে (من لا يماثلنا في ما أخأ الله علينا بأسيافنا و رماحنا)। আমাদের পরিশ্রমের ফলে এগুলো অর্জিত হয়েছে। আর এখন তুমি অনারবদেরও আমাদের সমকক্ষ ভাবছ?” হযরত আলী ওয়ালিদের প্রস্তাবের জবাব কি দিয়েছিলেন ইতিহাস তা বিস্তারিত বর্ণনা করেনি,তবে এটুকু স্পষ্ট যে,তিনি মিম্বারে গিয়ে কঠোরভাবে তার জবাব দিয়েছিলেন। কিন্তু যেহেতু তালহা ও যুবাইর রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর নবুওয়াতের প্রথম যুগের সাহাবী ছিলেন সেহেতু তিনি তাঁদের জবাব দিলেন এভাবে : “আপনারা জানেন,এমন প্রক্রিয়ার প্রণেতা আমি নই। আপনাদেরকে যে অন্যদের সমকক্ষ করেছি,এরূপ করতে আমরা স্বয়ং রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-কে দেখেছি। আপনারাও তা দেখেছেন এবং আমিও তা দেখেছি (قد وجدت أنا و أنتما رسول الله يحكم بذلك)। তাই আমি নতুন কিছু করিনি। আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর পথকেই অনুসরণ করছি এবং করব।”

দেখুন হযরত আলীর যুক্তি! তিনি চেয়েছেন রাসূলের আনীত উন্নত এক বিশ্বাস ও মূল্যবোধের ওপর তাঁর সময়ের সমাজের ভিত্তি স্থাপন করতে এবং ঐ বিশ্বাস ও মূল্যবোধকে দৃঢ়তা দান করতে। তিনি এজন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়েছেন,সফলও হয়েছেন;কিন্তু এর জন্য তাঁকে যথেষ্ট মূল্য দিতে হয়েছে। এ চেষ্টার মূল্য হলো তিনটি বড় যুদ্ধ যার মুখোমুখি তাঁকে হতে হয়েছিল খেলাফতের দায়িত্ব পাওয়ার পর। আমরা জানি যে,রাসূল (সা.)-এর ওফাতের পর খেলাফতের দায়িত্ব হযরত আলী (আ.)-এর পাওয়ার কথা ছিল। তিনি এটিকে তাঁর ন্যায্য অধিকার বলে জানতেন। কিন্তু পঁচিশ বছর এজন্য কোন পদক্ষেপ নেননি। কেউ তাঁকে তাঁর অধিকারের কথা স্মরণ করিয়ে দিলে তিনি তাদের থামিয়ে দিতেন। খেলাফতের বিষয়টি নিয়ে অন্যদের প্রশ্নের উত্তর প্রদানে তিনি বিভিন্ন সময়ে নিশ্চুপ ছিলেন এবং পঁচিশ বছরে তিনি তেমন কোন প্রতিক্রিয়াও দেখাননি। কিন্তু সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটি খেলাফত হতে কম গুরুত্বপূর্ণ মনে হলেও এ ক্ষেত্রে তাঁর প্রতিক্রিয়া ছিল তীব্র। যেহেতু সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি নবী প্রবর্তিত মৌলনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত ও পুনর্জীবিতকরণের কাজ,সেহেতু তিনি তিনটি বড় যুদ্ধের ক্ষতিও মেনে নিয়েছেন। দেখুন সামাজিক ন্যায়ের বিষয়টি হযরত আলীর দৃষ্টিতে কতটা গুরুত্বপূর্ণ যে,তিনি জামাল,সিফ্ফিন ও নাহরাওয়ানের মতো তিনটি যুদ্ধের বিনিময়েও তা অর্জন করতে চেয়েছেন! এটি আমীরুল মুমিনীনের এক মহৎ কর্ম। তিনি বলেছেন : “যদি কোন মুমিন ব্যক্তি আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে থাকে,যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে থাকে,বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে,তাহলে তার অধিকার খর্ব করা উচিত নয়। কিন্তু কোন ক্ষেত্রে যদি ঐ মুমিন ব্যক্তি অন্যায় করে তাহলে কখনই উচিত নয় যে,তার অবদান ও ভূমিকার কারণে তার অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া;বরং সে ব্যক্তি কারো অধিকার খর্ব করলে তার নিকট হতে অধিকার ফিরিয়ে না নেয়া অন্যায় বলে পরিগণিত হবে।”

সুতরাং কারো অবদান রাখা ও অন্যায় আচরণ- এ দু’টি বিষয়কে অবশ্যই আলাদা করে দেখা উচিত। অর্থাৎ কোন ভালো,উজ্জ্বল ঐতিহ্যসম্পন্ন ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা ব্যক্তির অধিকার সব সময় সংরক্ষিত,কিন্তু ঐ একই ব্যক্তি যদি অন্যায় করে,তবে তার অবদান রাখা যেন তার সঠিক বিচারের পথে অন্তরায় না হয়;বরং তার অন্যায় ও অন্যের অধিকার খর্বের শাস্তি তাকে পেতে হবে। এ ক্ষেত্রে তার অবদানের কথা বিবেচনা করে তার অন্যায় আচরণকে কখনই উপেক্ষা করা যাবে না। এটিই আমীরুল মুমিনীন আলীর যুক্তি। নাজ্জাশী ছিল হযরত আলীর পক্ষে তাঁর গুণগানকারী একজন কবি যে সিফ্ফিন যুদ্ধে যোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করে ও হযরত আলীর খেলাফতের বৈধতার সপক্ষে সবচেয়ে সুন্দর ও অর্থবহ কবিতা রচনা ও আবৃত্তি করেছিল,কিন্তু ঐ একই ব্যক্তি যখন রমযান মাসে মদ্যপান করেছে বলে হযরত আলী জানলেন,তখন তাকে সর্বসমক্ষে মদপানের শাস্তিস্বরূপ হাদ (বেত্রাঘাত) জারী করলেন। নাজ্জাশীর গোত্র ও পরিবারের সদস্যরা ঘটনাটি জানতে পেরে আমীরুল মুমিনীনের নিকট এসে বলল : “আপনি আমাদের গোত্রের সম্মানহানি করেছেন,নাজ্জাশী আপনার সপক্ষের এক ব্যক্তি ও সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও আপনি তার প্রতি এরূপ আচরণ করলেন?” হযরত আলী জবাবে বললেন : “আমি তেমন কিছুই করিনি। একজন মুসলমান ইসলামের বিধি লঙ্ঘন করেছে,আমিও তার ওপর ঐশী বিধান জারী করেছি,যেহেতু এটি আমার দায়িত্ব।” এ ঘটনার পর নাজ্জাশী হযরত আলীকে ত্যাগ করে মুয়াবিয়ার শিবিরে গিয়ে ভিড়ে। কিন্তু এতে তাঁর কোন অনুশোচনা হয়নি,কখনও বলেননি যে,হায়! নাজ্জাশী আমার হাতছাড়া হলো;বরং বলেছেন : “নাজ্জাশী ভুল করেছে,যদি সে থাকত তাহলে তারই মঙ্গল হতো।”

এরূপ ঘটনা হযরত আলীর জীবনে অনেক ঘটেছে। একবার বনি আসাদ গোত্রের এক ব্যক্তির ওপর হাদ জারী হলে তার গোত্র (হযরত আলীর সঙ্গে তাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল) ইমাম হাসানের নিকট এসে তাঁকে বিষয়টি মীমাংসার জন্য মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিল। ইমাম হাসান বললেন : “আপনারা আমার পিতাকে চেনেন। তাঁকেই সরাসরি বলুন।” তারা হযরত আলীর শরণাপন্ন হলে তিনি বললেন : “আমার ইখতিয়ারে যতটুকু আছে ততটুকু করার চেষ্টা করব।” তারা খুশী হয়ে চলে গেল। পথে ইমাম হাসানের সঙ্গে দেখা হলে তিনি জানতে চাইলেন আমীরুল মুমিনীন কি বললেন। তারা বলল,তিনি তাঁর সাধ্যমতো করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ইমাম হাসান হেসে বললেন : “তবে তার ওপর হাদ জারীর প্রস্তুতি নিন।” কয়েক দিনের মধ্যেই ঐ ব্যক্তিকে এনে তার ওপর হাদ জারীর ব্যবস্থা করা হলো। তার গোত্র এসে আমীরুল মুমিনীনকে বলল : “হে আলী! আপনি আমাদেরকে আপনার ইখতিয়ার মতো কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।” তিনি বললেন : “আল্লাহর বিধান আমার ইখতিয়ারের অধীন নয়।” হযরত আলীর নীতি ছিল এরূপ। আল্লাহর বিধানের ক্ষেত্রে বন্ধু-শত্রু সকলেই তাঁর নিকট ছিল সমান।

আমিরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)-এর খাদ্য,পোশাক,ব্যক্তিগত জীবন,অর্থনৈতিক অবস্থা,সন্তানদের অবস্থা-সবই ছিল সাধারণ। এক রাবীর সূত্রে হাদীস গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে,“দেখলাম ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন খেতে বসেছেন। তাঁদের খাবার ছিল যবের রুটি,সবজি ও সিরকা। তাঁদেরকে বললাম : আপনারা বিশাল ইসলামী রাষ্ট্রের শাসনকর্তার সন্তান। বাজারে এত নামী-দামী খাবার থাকতে আপনারা এগুলো খাচ্ছেন? তাঁরা জবাবে বললেন : তুমি আমাদের পিতার অবস্থা সম্পর্কে অবগত নও। তিনি তাঁর পরিবার নিয়ে এভাবেই জীবন কাটান।”

হযরত আলীর কন্যা উম্মে কুলসুমের ঘটনাটিও আপনাদের নিশ্চয় জানা আছে। তিনি বায়তুল মালের দায়িত্বশীল আবু রাফের নিকট থেকে ঈদের দিনে পড়ার জন্য গলার হার আমানত হিসাবে নিয়েছিলেন। হযরত আলী এ ক্ষেত্রে তাঁর কন্যার সাথে কি আচরণ করেছেন! এরূপ ঘটনা প্রচুর বর্ণিত হয়েছে। স্বীয় ভ্রাতা আকীল তাঁর নিকট এসে বায়তুল মাল হতে এক থলে গম ধার চাইলে তিনি লৌহ শলাকা আগুনে পুড়িয়ে তার হাতে ছ্যাকা দিতে উদ্যত হলেন। বুঝিয়ে দিলেন যে,দরিদ্র ব্যক্তিরা যাদের সঙ্গে তাঁর আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই,তারা তো তাঁর নিকট এসে এরূপ চাইতে পারছে না। যদি তিনি নিজ আত্মীয়দের বায়তুল মাল হতে দেন,তাহলে কিয়ামতে তাঁকে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।

স্বীয় ভ্রাতুষ্পুত্র ও জামাতা আবদুল্লাহ্ ইবনে জাফরের চরম অর্থসংকটে যখন সে তার ঘরের আসবাবপত্র বিক্রি করতে উদ্যত হয়েছিল তখনও তিনি তাকে সাহায্যে করেননি।

হযরত আলী (আ.) তাঁর শাসনামলে যখন ইসলামী রাষ্ট্রের বৈষয়িক উন্নয়ন ঘটেছিল,রাসূল (সা.)-এর সময় হতে কয়েক গুণ সম্পদশালী ব্যাপক এক ভূ-খণ্ডের শাসনকর্তা হয়েছিলেন,তখনও তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে,এরূপ পরিস্থিতিতেও ইসলামের মৌলিক বিধি-বিধান বাস্তবায়ন করা সম্ভব। ইসলামের আধ্যাত্মিকতা,ন্যায়পরায়ণতা,ন্যায়বিচার,সামাজিক সাম্য,জিহাদ,ব্যক্তি ও সমাজ পুনর্গঠন,যোগ্য ও মুমিন ব্যক্তিত্বের ব্যবস্থাপক হওয়া ও তাঁর ও শাসন- এরূপ মৌলিক লক্ষ্যসমূহ বাস্তবায়নে আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)-এর বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা আপনারা শুনেছেন। তিনি তাঁর কর্মের মাধ্যমে প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে,সকল অবস্থা ও পরিবেশেই এই মৌলনীতিসমূহ বাস্তবায়ন করা সম্ভব। এটি হযরত আলীর এক বিরাট সফলতা। হযরত আলী কি পোশাক পড়তেন ইসলামের মৌলনীতি তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয় যে বলব,তিনি যেহেতু লুঙ্গী ও জোব্বা পড়তেন,সেহেতু আমরাও তা-ই পড়ব। ইসলামের মৌলনীতি হলো তাওহীদ,সাম্য,ইনসাফ বা ন্যায়বিচার,মানুষকে তার ন্যায্য অধিকার দান,দরিদ্রদের সাহায্যে এগিয়ে যাওয়া,ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে কঠোর ও দৃঢ়ভাবে দাঁড়ানো,সত্য ও ইসলামের জন্য আত্মনিবেদন,সত্যের প্রতিরক্ষায় দৃঢ়তা প্রদর্শন এবং নির্যাতিতের পাশে দাঁড়ানো। এগুলোই ইসলামের মৌলনীতি এবং সকল যুগ ও সকল স্থানে এ মৌলনীতি বাস্তবায়ন সম্ভব।

আমরা আজ পর্বতের চূড়া সম্পর্কে কথা বলছি। কে সাহস রাখে আকাশচুম্বী পর্বতের চূড়ার সমকক্ষ হতে পারে। আমীরুল মুমিনীনের পরে কারো পক্ষেই তাঁর মতো হওয়া সম্ভব নয়।

আমাদের চতুর্থ ইমাম হযরত যয়নুল আবেদীন (আ.) হযরত আলীর নাতি এবং একজন নিষ্পাপ ব্যক্তিত্ব (মাসুম) যিনি ইবাদতের ক্ষেত্রে ছিলেন বিরল। তাঁকে যখন প্রশ্ন করা হলো : কেনো এত ইবাদত করেন? তিনি বললেন : “হযরত আলীর ইবাদতের তুলনায় এটি কিছূই নয়।” অর্থাৎ যে ইমামকে ‘অত্যধিক ইবাদতকারী’ ও ‘অত্যধিক সিজদাকারী’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে তিনিও বলেছেন আলীর ইবাদতের তুলনায় তাঁর ইবাদত কিছুই নয়। যেখানে আমাদের সময়কার কোন ইবাদতকারীর সঙ্গে ইমাম সাজ্জাদের দূরত্ব সহস্র ফারসাখ হতেও অধিক।

আমীরুল মুমিনীন আদর্শ ও চলার পথ আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন। ইসলামী রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রগুলোও আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। প্রমাণ করেছেন যে,ইসলামী শাসনই ন্যায়ের শাসন,সাম্যের শাসন,জনগণের সমস্যা সমাধানের শাসন,মানুষের অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের শাসন,অন্যায় ও জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শাসন। এগুলোর অভাবই মানবেতিহাসের সমস্যা। পূর্বেও মানব জাতি এ সমস্যার মুখোমুখি ছিল। আজও একই সমস্যার মুখোমুখি। বর্তমানে বিশ্ব-দুর্বৃত্ত পরাশক্তির অধিকারীররা বিশ্বকে স্বীয় করায়ত্তে আনার চেষ্টায় রত। এদের শক্তিমত্তার প্রদর্শনীতে জাতিসমূহ শোষিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে,সহস্র মানুষকে প্রতিদিন প্রাণ দিতে হচ্ছে। ইসলাম ও হযরত আলী (আ.)-এর শাসন-ব্যবস্থা এ সবেরই বিরুদ্ধে। ইসলাম একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে কোন দুর্বলের ওপর ক্ষমতাশালীর অত্যাচারের যেমন বিরোধী,আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও তেমনি দুর্বল রাষ্ট্রের ওপর শক্তিশালী রাষ্ট্রের শোষণ ও নিপীড়নের বিরোধী। অর্থাৎ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় পর্যায়ে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা হযরত আলী (আ.)-এর লক্ষ্য ছিল।

আমি আমার প্রথম খুতবার শেষে একটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। তা হলো হযরত আলীকে আপনারা শিয়া ও সুন্নীদের মধ্যে বিভেদের লক্ষ্য বানাবেন না। আমীরুল মুমিনীন ঐক্যের প্রতীক,বিভেদের প্রতীক নন। আমাদের নিকট এরূপ অপচেষ্টার তথ্য পর্যাপ্ত রয়েছে। আমি লক্ষ্য করছি অদৃশ্য হাত ইসলামের বিভিন্ন মাযহাবের মধ্যে অনৈক্যের বীজ বপনের চেষ্টায় লিপ্ত,শিয়া-সুন্নী সংঘর্ষ সৃষ্টির অপপ্রয়াসে তারা রত। শিয়াদের বিরুদ্ধে বই লেখা হচ্ছে,সুন্নীদের বিরুদ্ধে বই লেখা হচ্ছে,উভয় পক্ষকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর চেষ্টায় সীমান্তের বাইরে থেকে অর্থ দিয়ে এরূপ বই লেখানো হচ্ছে। উভয় পক্ষের অর্থের উৎস একই। প্রত্যেক বৈধ মাযহাবেরই অধিকার আছে নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্বাসকে যুক্তির আলোকে উপস্থাপনের। বিভিন্ন মাযহাবের ব্যক্তিরা এক টেবিলে বসে যুক্তিনির্ভর বক্তব্য উপস্থাপনের মাধ্যমে অপরের ওপর  বিজয়ী হওয়ারও সুযোগ রয়েছে,কিন্তু সৌহার্দ্র্য ও সম্প্রীতির পরিবেশ নষ্ট করে যুদ্ধ ও সংঘর্ষের পরিবেশ সৃষ্টি কখনই কাঙ্ক্ষিত নয়।

আমীরুল মুমিনীন ঐক্যের প্রতীক। শিয়া-সুন্নী নির্বিশেষে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে ইসলামের ইতিহাসে একদল লোক সব সময় হযরত আলীর শত্রু ছিল যারা ‘নাসেবী’ নামে প্রসিদ্ধ। উমাইয়্যা,আব্বাসী ও পরবর্তী সকল যুগেই হযরত আলীর প্রতি শত্রুতা পোষণকারী এরূপ ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতি ছিল,কিন্তু শিয়া-সুন্নী নির্বিশেষে সাধারণ মুসলমানরা আমীরুল মুমিনীনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল। আপনারা লক্ষ্য করুন সুন্নী মাযহাবের ইমামরা হযরত আলীর প্রশংসায় কবিতা রচনা করেছেন। আপনারা ইমাম শাফেয়ী থেকে বর্ণিত প্রসিদ্ধ সে কবিতাটি জানেন যাতে শুধু হযরত আলী নন,আহলে বাইতের সকল সদস্য ও অধিকাংশ ইমামের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়েছে। আমাদের শিয়াদের বিশ্বাস অত্যন্ত পরিষ্কার ও যুক্তিনির্ভর,অন্যদের নিকট হয়তো বিষয়টি ততটা স্পষ্ট নয়। সংলাপ ও বিতর্কের মাধ্যমে বিষয়টি অন্যদের নিকট স্পষ্ট করা সম্ভব। আমাদের যুক্তি খুবই শক্তিশালী। কিন্তু একদল লোক ইরান,ইরাক ও ইসলামী বিশ্বের অনেক স্থানে দ্বন্দ্ব ও বিভেদ সৃষ্টির প্রচেষ্টায় লিপ্ত। বিশেষত ইরানের মধ্যে তাদের প্রচেষ্টা হলো সংঘর্ষ সৃষ্টি করা। আমরা জানি কোথা থেকে তাদের সাহায্য করা হচ্ছে। যা হোক,আজকে হযরত আলী (আ.)-এর শাহাদাত দিবস। আমাদের ওপর আরোপিত এ মুসিবতের স্মরণে কয়েকটি বাক্য বলছি।

হে আমীরুল মুমিনীন! আমার পক্ষ থেকে সালাম গ্রহণ করুন। সৌভাগ্য তাদের যারা আজকে নাজাফে হযরত আলীর পবিত্র রওজার পাশে দাঁড়িয়ে তাঁকে সালাম দিচ্ছেন। আমরা দূর থেকে আপনার প্রতি সালাম জানাই- হে মুমিনদের নেতা! হে মুত্তাকীদের পুরোধা এবং রাসূলের উত্তরাধিকারীদের প্রধান!

১৯ রমজানের ফজরের ওয়াক্তে যখন মর্মান্তিক এ ঘটনা ঘটল (হযরত আলী নামাজরত অবস্থায় মসজিদে আঘাতপ্রাপ্ত হলেন) তখন সূর্যোদয়ের পর কুফা ও অন্যান্য শহরে এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল। হযরত আলী কুফায় খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। নারী,শিশু,যুবক,বৃদ্ধ সকলেই চরম উদ্বিগ্ন হলেন,বিশেষত হযরত আলীর ঘনিষ্ঠ সঙ্গীরা। গতকালের মতো এমনি এক বিকেল বেলায় সকলে হযরত আলীর গৃহের সামনে সমবেত হলেন।

এক বর্ণনা মতে,ইমাম হাসান যখন দেখলেন সকলে অধীর আগ্রহে হযরত আলীকে দেখার জন্য অপেক্ষা করছে,কেউ সেখান থেকে নড়ছে না তখন তিনি সকলকে লক্ষ্য করে বললেন : “প্রিয় ভাই-বোনেরা! আমীরুল মুমিনীনের অবস্থা ভালো নয়। তাঁকে দেখা এখন সম্ভব নয়। আপনারা এখন ফিরে যান।” কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে নিরাশ হয়ে সকলে আস্তে আস্তে ফিরে যেতে লাগল। আসবাগ ইবনে নাবাতা বলেন : “আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। যতই চেষ্টা করলাম,কিন্তু হযরত আলীর গৃহ হতে দূরে যেতে মন চাইল না। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর ইমাম হাসান (আ.) গৃহ হতে বের হয়ে আমাকে দেখে বললেন : আসবাগ! এখনও দাঁড়িয়ে আছ? আমি বললাম : হে রাসূলের সন্তান! আমীরুল মুমিনীনকে না দেখে যেতে মনটা সায় দিচ্ছে না। যদি একটু সুযোগ পেতাম তাঁকে দেখার। হযরত আলী ভিতর থেকে অনুমতি দিলে তাঁর কক্ষে প্রবেশ করলাম। দেখলাম আমীরুল মুমিনীন বিছানায় শুয়ে আছেন। তাঁর মাথায় আঘাতের স্থানে হলুদ পট্টি বাঁধা রয়েছে। তাঁর শরীর এতটা হলুদ হয়ে গিয়েছে যে,আমি বুঝতে পারছিলাম না,মাথায় বাঁধা কাপড়টি বেশি হলুদ,না তাঁর দেহের বর্ণ।” আমীরুল মুমিনীন কখনও জ্ঞান হারাচ্ছিলেন,কখনও জ্ঞান ফিরে পাচ্ছিলেন। একবার জ্ঞান ফিরে আসলে আসবাগের হাত ধরে একটি দীর্ঘ হাদীস বর্ণনা করেন। তারপর আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। সাহাবীদের মধ্যে আসবাগ ইবনে নাবাতা সর্বশেষ ব্যক্তি যিনি আমীরুল মুমিনীনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। তারপর আর কেউই তাঁকে দেখার সৌভাগ্য লাভ করেনি।

দ্বিতীয় খুতবা

বিস্মিল্লাহির রাহমানির রাহীম

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর যিনি বিশ্বজগতের প্রতিপালক। তাঁর নবী (সা.) ও নবীর আহলে বাইতের ওপর দরুদ ও সালাম। দ্বিতীয় খুতবায় দু’টি বিষয় নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা রাখব। এর প্রথমটি সম্প্রতি ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প নিয়ে- যে বিষয়টি নিয়ে হৈ চৈ করে পরিবেশ ঘোলা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। দ্বিতীয় বিষয়টি কুদ্স দিবস ও ফিলিস্তিনের অবস্থা নিয়ে।

ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প নিয়ে যে হৈ চৈ করা হচ্ছে তার পেছনে আমেরিকার সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য রয়েছে। যদিও এ বিষয়টি আমেরিকার প্রভাববলয়ের অধীন শত্রু দেশগুলোর পক্ষ থেকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান ও ইরানী জাতির বিরুদ্ধে তিলকে তাল করার অপচেষ্টা ছাড়া কিছু নয় তা সবার কাছেই পরিষ্কার। কিন্তু তাদের এ অপচেষ্টার উদ্দেশ্য কি? আমি সংক্ষিপ্তভাবে এর উত্তর দিচ্ছি। যে বিষয়টি কোন এক জাতির স্বাধীনতা ও সার্বভৌম ক্ষমতাকে শক্তিশালী করতে সহায়ক সে বিষয়টি বিশ্ব আগ্রাসী শক্তির অসন্তোষের কারণ। কারণ তারা সমগ্র বিশ্বের প্রতি লালায়িত এবং বিশ্বকে নিজেদের করায়ত্তে আনার প্রচেষ্টায় লিপ্ত। তারা চায় বিশ্বের সকল দেশ ও সম্পদ তাদের অধীনে থাকুক- পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদ,অর্থ বাজার,শ্রম বাজার,শিল্প বাজার সবকিছু। এ সব আগ্রাসী দেশগুলোর পশ্চাতে রয়েছে বহুজাতিক কোম্পানী,শিল্প ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানসমূহ।

বিশ্ব রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হলো তারা। আমেরিকার বর্তমান শাসকগোষ্ঠী এই আন্তর্জাতিক শিল্প ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুগত। যদি এ প্রতিষ্ঠানগুলো মধ্যপ্রাচ্যে নতুন কোন সম্পদের সন্ধান পায় কিংবা অত্র এলাকার তেল সম্পদ হস্তগত করার মাধ্যমে তাদের সম্ভাব্য দেউলিয়াত্বের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা দেখে কিংবা যায়নবাদী ইসরাইলী সরকারকে সহযোগিতা করার নিমিত্তে অথবা কোন অর্থনৈতিক সুবিধা সৃষ্টির প্রয়াসে মধ্যপ্রাচ্যে আসার প্রয়োজন বোধ করে তাহলে দীর্ঘমেয়াদী এক পরিকল্পনা প্রস্তুত করে যার সুবাদে স্থায়ীভাবে এ এলাকায় অবস্থান গ্রহণ করতে পারে।

এত অধিক অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষতির ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও এ ধরনের যুদ্ধের পরিকল্পনা হতে বোঝা যায় যে,এর পেছনে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তিসমূহের উদ্দেশ্য ও হাত রয়েছে। তাই তাদের এ উদ্দেশ্যের পরিপন্থী ও প্রতিবন্ধক কোন দেশ যদি জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে চায়,তাহলে স্বাভাবিকভাবেই তাদের রুষ্ট হওয়ার কথা।

তারা উন্নয়নশীল দেশে শিল্প স্থাপনে আগ্রহী,কিন্তু সে শিল্প হবে তাদের মূখাপেক্ষী। তারা বিমান দিতে আগ্রহী,কিন্তু যে বিমান খুলে দেখার ও তার খুচরা যন্ত্রাংশ প্রস্তুতের অধিকার কারো নেই। বিমানের কোন যন্ত্রাংশ নষ্ট হলে তাদের নিজস্ব প্রকৌশলী এসে তা খুলে তাদের উৎপাদন কারখানায় নিয়ে তা ঠিক করে দেবে অথবা তারাই পরিবর্তন করে দেবে। এ অবস্থা ইসলামী বিপ্লবের পূর্বে ইরানে ছিল। পারমাণবিক চুল্লী তাদের তাঁবেদার ও অনুগত শাসকদের (যেমন তাগুতী রেজা শাহ পাহলভী) দিতে চাইলেও স্বাধীনতাপ্রিয় ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের ক্ষেত্রে তারা তা দিতে নারাজ। কিন্তু তারা না দিলেও যখন ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিশেষজ্ঞ ও প্রকৌশলীরা নিজস্ব প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী শক্তির মাধ্যমে পারমাণবিক জ্বালানী ও বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের দুয়ারে পৌঁছেছে তখন তাদের মধ্যে তিক্ত অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছে। কারণ,এটি তাদের উদ্দেশ্যের বিপরীত ও অনাকাঙ্ক্ষিত। এ জন্যই তারা এর বিরোধী।

লক্ষ্য করুন,যখন ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের অভ্যুদয় ঘটল তখন তারা বুঝতে পারল ইরান তাদের আগ্রাসী শক্তি ও ক্ষমতা বিরোধী এবং তাদের স্বার্থের জন্য হুমকি প্রয়োগের তাই তখন থেকেই তারা ইরানের বিরোধিতা শুরু করল। এ বিরোধিতা ইরান হওয়ার কারণে নয়;বরং ইসলামী দেশগুলোর মধ্যে ইরান প্রথম এ মনোভাবের পরিচয় দেয়ার কারণে ইসলামী বিশ্বে আকর্ষণীয় বলে গৃহীত হয়েছে ও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে তাই। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নতুন ধারার সৃষ্টি করেছে। এ নতুন ধারা ও আদর্শ তাদের ভিত্তিকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তারা নিজেদের সান্ত্বনা দিত এ বলে যে,ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান টিকে থাকতে পারবে না। বর্তমান পৃথিবীতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সবকিছুর নিয়ন্ত্রক। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মাধ্যমেই অর্থ-সম্পদ অর্জিত হয়। তাই ইরানের মতো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া এবং অর্থনৈতিক অবরোধে পিষ্ট এক দেশ ভেতর থেকে শুকিয়েই শেষ হয়ে যাবে। এ কারণেই ইসলামী বিপ্লবের পর তারা প্রচার চালাত (নিজেদের সান্ত্বনা দিত) এভাবে যে,দু’মাস,এক বছর কিংবা পাঁচ বছর পর এ বিপ্লবের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। বিপ্লবকে ধ্বংস করার জন্য তারা ইরানের ওপর অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত অবরোধ আরোপ করেছিল,যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল,শত্রুকে সর্ববিধ সাহায্য করেছিল। এক কথায় ইরানের ওপর সব ধরনের অসুবিধা চাপিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু পঁচিশ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও তারা দেখছে ইরান এ সব অবরোধ ও অসুবিধার আবর্জনা সরিয়ে বেরিয়ে এসেছে,মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে,নিজের ভিত্তিকে মজবুত করেছে এবং আত্মনির্ভরশীল ও আশাবাদী এক জাতিতে পরিণত হয়েছে। ইরান বিজ্ঞান,প্রযুক্তি,শিল্প- সব ক্ষেত্রেই এগিয়ে গিয়েছে;কোন কোন ক্ষেত্রে পৃথিবীতে প্রথম কাতারে এসে দাঁড়িয়েছে। পারমাণবিক প্রকল্পের কথাই ধরুন। পৃথিবীতে অনেক দেশই পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করছে,কিন্তু তাদের সীমিত কয়েকটি মাত্র দেশ পারমাণবিক জ্বালানী উৎপাদনে সক্ষম। এ ক্ষেত্রে ইরান প্রথম সারির দশটি দেশের একটি।

মৌলিক কোষ বা মাতৃকোষ (Fundamental or mother cell) উৎপাদন ও তার বিস্তারের ক্ষেত্রে গবেষণা এ দেশের মুমিন ও বিপ্লবী দেশপ্রেমিক যুবকেরা সম্প্রতি সফলতার সাথে সম্পাদন করেছে। নিজস্ব প্রযুক্তি ও গবেষণাগারে তারা হৃদপিণ্ড,অস্থিমজ্জা ও অন্যান্য মৌলিক কোষ উৎপাদনে সক্ষম হয়েছে- তা সংরক্ষণের প্রযুক্তিও তাদের হস্তগত হয়েছে। সাত-আট মাস পূর্বে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিজ্ঞানী ও গবেষকরা এসেছিলেন। তাঁদের এগুলো বিশ্বাস হয়নি,কিন্তু এসে দেখে বিশ্বাস হয়েছে ও তাঁরা স্বীকার করেছেন যে,অনেক বড় কিছু করতে পেরেছে আমাদের গবেষকরা। তাঁদের এ স্বীকারোক্তি ইরানের টেলিভিশনে প্রচারিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ইরান পৃথিবীর প্রথম দশটি দেশের একটি।

অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রেও লক্ষ্য করে থাকবেন ইসলামী বিপ্লবের পর ইরান সত্তরটি বড় বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছিল। তার অধিকাংশই এখন সম্পন্ন হয়েছে। এখনও সরকারের তত্ত্বাবধানে সমান সংখ্যক বাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে। ছোট,বড়,মাঝারি বিভিন্ন ধরনের বাঁধসমূহ জলবিদ্যুৎ,বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ,সেচ,মৎস্য চাষ ও এরূপ আরো অনেক প্রকল্পের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ বাঁধগুলো শতভাগ নিজস্ব প্রযুক্তিতে ও নিজস্ব প্রকৌশলীদের মাধ্যমে প্রস্তুত হয়েছে ও হচ্ছে। বিপ্লবের পূর্বে তাগুতী শাসনামলে বাঁধ তৈরির কাজ শুরু হলেও সে সময়ে মাত্র দশ-বারোটি এরূপ বাঁধ তৈরি হয়েছিল বিদেশী প্রকৌশলীদের মাধ্যমে,তাও আবার ত্রুটিপূর্ণ প্রযুক্তিতে। কংক্রিট,বিটুমিন ও মাটির তৈরি উন্নত প্রযুক্তির বৃহদাকার বাঁধ (পানি ধারণ ক্ষমতার দৃষ্টিতে) তৈরিতে (বিশেষজ্ঞদের জানানো পরিসংখ্যান অনুসারে) আমাদের দেশ প্রথম সারির ছয়টি দেশের একটি।

সামরিক ও অন্যান্য প্রযুক্তিতেও আমাদের অবস্থান বেশ ওপরে,এমনকি সাংস্কৃতিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও আমরা বেশ এগিয়েছি। আমাদের শক্তিশালী ভিত্তির ইসলামী সংস্কৃতির ক্ষতিসাধনের জন্য শত্রুরা সর্ববিধ প্রচেষ্টায় রত। উঁই পোকার মতো তারা এ সংস্কৃতিতে অবক্ষয় সৃষ্টির চেষ্টায় সব রকম পন্থাই অবলম্বন করেছে। তদুপরি ইসলামের মৌল সংস্কৃতি এবং ইসলামী জ্ঞান ও দর্শনের ধারা এ দেশে ক্রমোন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

আজকে মোল্লা সাদ্রার দর্শন পৃথিবীকে বিস্মিত করছে,তাদের নিরপেক্ষ চিন্তাবিদদের দ্বারা প্রশংসিত হচ্ছে। আজ ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সকল চাপকে উৎরিয়ে বেরিয়ে এসেছে। তারা ভেবেছিল বিভিন্ন ধরনের চাপের মাধ্যমে এ বিপ্লবকে বিনাশ করতে। কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছে ইরান মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। শত্রুদের ভ্রূকুটিকে উপেক্ষা করে,সকল আবর্জনা ও জঞ্জাল সরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়টি তাদের ক্রোধের কারণ হয়েছে। তারা অভিযোগের ধুয়ো তুলে বলছে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে। আমরা পূর্বে বারবার বলেছি এবং এখনও বলছি,ইরানের পারমাণবিক অস্ত্রের প্রয়োজন নেই,এ জাতি নিজেই পারমাণবিক বোমার চেয়ে লক্ষ গুণ শক্তিশালী।

আমাদের পারমাণবিক অস্ত্র হলো এই শত-সহস্র মুমিন যুবক যারা এ জাতির জন্য নিবেদিত। যে জাতির লক্ষ-লক্ষ ত্যাগী ও মুমিন যুবক রয়েছে,যে জাতি ঐক্যবদ্ধ,তাদের পারমাণবিক বোমার কোনই প্রয়োজন নেই। পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদন,সংরক্ষণ ও ব্যবহার কখনই শরীয়তসম্মত নয়। আমরা এরূপ কর্মের অবৈধতার বিষয়ে পূর্বেও ফতোয়া দিয়েছি। সকলেই তা অবগত।

আপনারা অবগত রয়েছেন যে,তাদের সঙ্গে আমাদের সমস্যা পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে নয়,তারাও এটি ভালোভাবে জানে। প্রকৃত ব্যাপার হলো ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের অগ্রগতি ও উন্নয়ন তাদের সহ্য হচ্ছে না। ইরানী জাতি এ কথা জানে এবং তাদের এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের শত্রুরা আমাদের জাতীয় ঐক্যকে ভীতির চোখে দেখে। তারা চায় এই জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট করতে। শত্রুরা যখন দেখে এ দেশের জাতীয় পর্যায়ের সকল ব্যক্তি কোন বিষয়ে একমত পোষণ করছে তখন চরমভাবে ক্ষুব্ধ হয়। যখন তারা লক্ষ্য করে যে,রাষ্ট্রপতি,প্রধান বিচারপতি,পার্লামেন্টের স্পীকার ও মন্ত্রীসভার সকল সদস্য কোন এক বিষয়ে একই রকম কথা বলছে তখন তারা (শত্রুরা) নিজের চুল নিজেই ছিঁড়তে চায়। তাই বিভেদ সৃষ্টির লক্ষ্যে তারা বিভিন্ন প্রচেষ্টা চালিয়েছে। গত দু’বছর ধরে প্রচার করা হচ্ছিল,এ দেশে দ্বৈত শাসন চলছে;দেশের অভ্যন্তরেও তাদের অনুচররা তাদের সুরে প্রচার চালাচ্ছিল। যদি এক দেশের অভ্যন্তরে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিভিন্ন ব্যক্তি মৌলিক কোন বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ ও তা ব্যক্ত করেন সেটি দ্বৈত মত ও দ্বৈত শাসন। এরূপ দ্বৈত মত পোষণ অনাকাঙ্ক্ষিত এবং দেশের জন্য ক্ষতিকর ও ধ্বংস আনয়নকারী। সবার কাছেই বিষয়টি স্পষ্ট। এরূপ মতদ্বৈততা এখানে নেই। তবে এটি সত্য যে,একটি দেশের সকল দায়িত্বশীল ব্যক্তি সকল বিষয়ে একমত পোষণ করবেন এমনটি সম্ভব নয়। তাই রাজনৈতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে মতের বিভিন্নতা ও দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য অস্বাভাবিক কিছু নয়। শত্রুরা যখন দেখে বিভিন্ন বিষয়ে মতপার্থক্য সত্ত্বেও জাতীয় বিষয়ে,দেশ ও ইসলামের মৌলিক বিষয়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ একরকম কথা বলছেন তখন তারা ক্ষুব্ধ হয়। যখন তারা দেখে এ দেশের যুবকরা ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে অংশগ্রহণ করছে তখন তারা অসন্তুষ্ট হয়। শবে কদরের এই রাতগুলোতে যখন লক্ষ-লক্ষ তরুণ জিহাদী মনোভাব নিয়ে হযরত আলীর শাহাদাতের স্মরণে সমবেত হয়ে অশ্রু বিসর্জন দেয়,পরস্পরকে কাছাকাছি অনুভব করে,তখন শত্রুরা চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন হয়,তাদের অন্তর ভারাক্রান্ত হয়। আলহামদুলিল্লাহ্,এ জাতি অত্যন্ত সচেতন ও সতর্ক। আপনাদের সব সময় এরূপ সচেতন  ও সতর্ক থাকার আহ্বান জানাচ্ছি।

শত্রুরা চায় এ দেশে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা না থাকুক,তারা চায় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা একে অপরের বিরুদ্ধে লেগে থাকুক,সর্বক্ষণ একে অপরের সমালোচনায় লিপ্ত থাকুক। বিশ্ববিদ্যালয়,অফিস-আদালত,বাজার,কারখানা,ব্যবসাকেন্দ্র,শিল্প প্রতিষ্ঠান সবখানে যেন অনৈক্য ও বিভেদ থাকে- এ অপচেষ্টায় তারা লিপ্ত। এ জাতির প্রত্যেক ব্যক্তিকে এ বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। তবেই আল্লাহর ইচ্ছায় আমরা উন্নয়ন ও সফলতার দিকে এগিয়ে যাব।

দ্বিতীয় যে বিষয়টি নিয়ে এখন আলোচনা করব তা হলো ফিলিস্তিন প্রসঙ্গ। আপনারা ইনশাআল্লাহ্ আগামী শুক্রবারে কুদ্স দিবসে যে বিক্ষোভ মিছিল করবেন তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ কাজকে ছোট করে দেখার কোন অবকাশ নেই। ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ও লক্ষ্যণীয় বিষয় রয়েছে যা ইতিহাসে চিরকালের জন্য লিপিবদ্ধ থাকবে। প্রথম বিষয়টি যায়নবাদী ইসরাইলের দ্বারা সম্পাদিত চরম অন্যায় যা তারা ফিলিস্তিনীদের বিরুদ্ধে চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের হত্যাযজ্ঞ ও নিপীড়নের ইতিহাস পৃথিবীতে মুছে যাওয়ার মতো নয়। একজন শাহাদাতকামী ফিলিস্তিনী যুবক- যে ফিলিস্তিনের ওপর ইসরাইলের চরম নিপীড়ন সহ্য করতে না পেরে তাদের হতে ন্যূনতম প্রতিশোধ গ্রহণের ইচ্ছায় নিজের জীবনকে বিপন্ন করে তাদের সামান্য একটু ক্ষতি সাধনের চেষ্টায় ব্রত হয়েছে,তার শাহাদাতের পর তারা এসে তার বাড়ী-ঘর বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দিয়ে,তার পিতা-মাতা,ভাই-বোনদের ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন ও নিপীড়ন চালানো হচ্ছে। তারা ট্যাংক নিয়ে ফিলিস্তিনী উদ্বাস্তু শিবিরে প্রবেশ করে,শহরগুলোকে বোমাবর্ষণে বিধ্বস্ত করে,তাদের কৃষিভূমি নষ্ট করে,মানুষ হত্যা করে চলেছে। আজকে ফিলিস্তিনের তরুণ-যুবক,শিশু,বৃদ্ধ,নারীসহ নিরস্ত্র শত শত লোককে হত্যা করা ইসরাইলের দৈনন্দিন কর্মে পরিণত হয়েছে। এটি ইতিহাসে মুছে যাবার নয়।

দ্বিতীয় যে বিষয়টি লক্ষ্যণীয় তা হলো ফিলিস্তিনীদের প্রতিরোধ ও ধৈর্য যা ইতিহাসে চিরন্তন হয়ে থাকবে। চারিদিক হতে শত্রু পরিবেষ্টিত হয়ে এভাবে প্রতিরোধ ও আত্মরক্ষার চেষ্টা সত্যিই বিরল। প্রতিদিন ক্ষুধা-তৃষ্ণার কষ্ট সহ্য করে,সন্তানদের লাশ বহন করে (সন্তান হারানোর কষ্ট বুকে নিয়ে),ধ্বংসপ্রাপ্ত কৃষিক্ষেত্র ও গৃহের দৃশ্য দেখেও তারা দমেনি- প্রতিরোধ অব্যাহত রেখেছে। সাবাস এ জাতির নারী-পুরুষ,তরুণ-তরুণী,শিশু ও বৃদ্ধদের। তাদের প্রতিরোধের এ বিরল ঘটনা ইতিহাসে চিরন্তন নজীর হিসাবে থাকবে।

তৃতীয় বিষয় হলো আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর চরম নীরবতা। ইউরোপসহ সারা বিশ্বের এত মানবদরদী,মানবাধিকারের দাবিদার ও প্রেমিকদের চোখের সামনে এ ঘটনাগুলো ঘটছে। যাদের হৃদয় মানবাধিকারের জন্য পোড়ে তারা এ ক্ষেত্রে নীরব কেন? অনেক ক্ষেত্রেই এ সব ব্যক্তির অত্যাচারীদের সহযোগিতা করতে অথবা নীরবতা পালন করতে দেখা যায় যা সত্যিই আশ্চর্যজনক! আমেরিকা তো নিজেই এই অন্যায়ের সহযোগী- তাদের হাত কনুই পর্যন্ত ফিলিস্তিনীদের রক্তে রঞ্জিত। যদি এ অন্যায়ের বিচারের জন্য কোন বিচারালয় প্রতিষ্ঠা করা হয় তাহলে অপরাধীর সারিতে শ্যারন ও ইসরাইলের পাশেই আমেরিকার স্থান হবে।

তাই আমেরিকার কথা বাদ দিয়ে ইউরোপ ও জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক সকল সংস্থার উদ্দেশে বলছি : বাস্তবে আপনাদের মানবাধিকারের প্রতি কোন শ্রদ্ধাবোধ আছে কি? প্রকৃতপক্ষে আপনাদের মানবাধিকারের সংজ্ঞা জানা নেই।

মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর শাসকবর্গ অন্যদের হতে ব্যতিক্রম নয়। তাদের নীরবতাও সত্যিই বিস্ময়কর। যে তিনটি বিষয় সম্পর্কেই আমি উল্লেখ করলাম এখন এ ক্ষেত্রে আমাদের দায়িত্ব কি? মুসলিম জাতি এ মুহূর্তে কি করতে পারে? কুদ্স দিবসে তারা রাস্তায় নেমে এসে এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে পারে,অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়ে ফিলিস্তিনীদের জানাতে পারে : আমরা তোমাদের সমর্থন করি,যদিও আমাদের শাসকরা তোমাদের সাহায্যে এগিয়ে যেতে দিচ্ছে না,কিন্তু জেনে রাখ,আমাদের অন্তর তোমাদের সাথে রয়েছে। এ বিষয়টি তাদেরকে সাহস ও অনুপ্রেরণা যোগাবে। এটি একটি বড় সহযোগিতা (যদি তোমার হাত দিয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে না পার,তাহলে মুখ দ্বারা তার প্রতিবাদ কর)।

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ্।*

জ্যোতি,৩য় বর্ষ,১ম সংখ্যা

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

বিভিন্ন ফিকাহর দৃষ্টিতে যাকাত
আল-কুরআনের মু’জিযা: একটি ...
সালাতে তারাবী না তাহাজ্জুদ ?
অর্থসহ মাহে রমজানের ৩০ রোজার দোয়া
ইসলাম ধর্ম, চিত্ত বিনোদন ও আনন্দ
জান্নাতুল বাকিতে ওয়াহাবি ...
কোরআনে কারিম তেলাওয়াতের আদব
মহানবীর ওফাত দিবস এবং ইমাম হাসান ...
পবিত্র কোরআনের আলোকে কিয়ামত
ইমাম হাসান (আ.)-এর জন্মদিন

 
user comment