বাঙ্গালী
Friday 29th of March 2024
0
نفر 0

ইসলামী বিচার পদ্ধতি

এ.এইচ এম. শওকত আলী
॥ এক ॥
ইসলামী জীবনদর্শনে অপরাধ প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা
মানবমন সাধারণভাবে অপরাধপ্রবণ। এই অপরাধপ্রবণ মনকে অপরাধমুক্ত করে সামাজিক শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন ন্যায়বিচার। কাজেই অপরাধ প্রতিরোধের কৌশল আত্মস্থ ও কার্যকর করার ব্যাপারে আমাদের অঙ্গীকার (ঈড়সসরঃসবহঃ) থাকতে হবে। অপরাধ প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিম্নে আলোচনা করা হলো।
ইসলামী শরীয়তে শাস্তি তিন প্রকার যথা-
প্রথমত : বিভিন্ন ধরনের কাফ্ফারা : এমন শাস্তি যা আল্লাহ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত : হদ্দ ও কিসাস (বিধিবদ্ধ শাস্তি) : ওই সমস্ত শাস্তি যা আল্লাহ কিতাব বা রাসূল (সা.)-এর হাদীস দ্বারা প্রমাণিত এবং এগুলো কার্যকর করার দায়িত্ব সরকারের। এক্ষেত্রে বিচারক বা সরকারের নিজস্ব মতামতের কোনো সুযোগ নেই। এ অপরাধ সংঘটিতকালে একদিকে যেমন সৃষ্টি জীবের প্রতি অন্যায় করা হয়, তেমনি অন্যদিকে স্রষ্টার নাফরমানী করা হয়। ফলে অপরাধী আল্লাহ ও তাঁর বান্দা উভয়ের কাছে দোষী বলে বিবেচিত হয়। যে অপরাধে আল্লাহ হকের প্রাবাল্য ধরা হয়েছে, তার শাস্তিকে ‘হদ্দ' আর যে অপরাধে বান্দার হককে শরীয়তের বিচারে প্রবল ধরা হয়েছে, তার শাস্তিকে ‘কিসাস' বলে। হদ্দ ও কিসাসের মধ্যে আরো একটি পার্থক্য এই যে, হদ্দকে আল্লাহর হক হিসেবে প্রয়োগ করা হয় বিধায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ক্ষমা করলেও হদ্দ অব্যবহার্য হবে না। যেমন- যার সম্পদ চুরি হয়ে যায়, সে ক্ষমা করলেও চোরকে নির্ধারিত শাস্তি দিতে হবে। কিন্তু ‘কিসাস' এর বিপরীত। কিসাসে বান্দার হক প্রবল হওয়ার কারণে হত্যা প্রমাণ হওয়ার পর হত্যাকারীর বিষয়টি নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীর ইখতিয়ারে ছেড়ে দেয়া হয়। সে ইচ্ছা করলে বিচার বিভাগের মাধ্যমে কিসাস হিসেবে তার মৃত্যুদ- কার্যকর করতে পারে কিংবা দিয়াত-রক্তপণ গ্রহণ করতে পারে কিংবা ক্ষমা করে দিতে পারে।
তৃতীয়ত : তাযীর : ইসলামী শরীয়ত সেসব অপরাধের শাস্তির কোনো পরিমাণ নির্ধারণ করেনি বরং বিচারকের বিবেচনার উপর ছেড়ে দিয়েছে তাকে তাযীর বলে। বিচারক স্থান, কাল ও পরিবেশ বিবেচনা করে অপরাধ দমনের জন্য যেমন ও যতটুকু শাস্তির প্রয়োজন মনে করেন ততটুকুই দিবেন। এক্ষেত্রে সরকার নিজস্ব আইন প্রণয়ন করতে পারে এবং বিচারককে তা মেনে চলতে বাধ্য করতে পারে। অবস্থা অনুযায়ী তাযীরকে লঘু থেকে লঘুতর, কাঠোর থেকে কঠোরতর এবং ক্ষমাও করা যায়। তাযীরের ক্ষেত্রে ন্যায়ের অনুকূলে সুপারিশ গ্রহণ করা যায়। কিন্তু হদ্দের বেলায় সুপারিশ করা এবং তা আমলে নেয়া কোনটাই বিধিসম্মত নয়।
অপরাধ দমনে ইসলামী বিধানের কতগুলো বৈশিষ্ট রয়েছে। যেমন-প্রতিরোধমূলক : ইসলাম অপরাধ সংঘটনের পথ খোলা রেখে মানুষকে অপরাধ করার সুযোগ দেয় না বরং অপরাধের কারণসমূহ যাতে সৃষ্টি না হয়, সে জন্য সংঘটিত হওয়ার পূর্বেই ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ইনসাফ ভিত্তিক : ইসলাম বিচারের ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা করে। অপরাধী এবং যে সমাজের বিরুদ্ধে সে অপারাধ করেছে, এ উভয়ের পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনা করে। ইসলাম চোরের হাত কেটে দিতে বলে কিন্তু যদি বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায় যে, চোর ক্ষুধার তাড়নায় চুরি করেছিল, সে প্রেক্ষিতে তাকে হাত কাটার মতো শাস্তি দেয়া হয় না। সামান্য জিনিস চুরির অপরাধেও চোরের হাত কাটা হয় না। অবিবাহিত নারী-পুরুষের ব্যভিচারের ক্ষেত্রে শাস্তির মাত্রা লাঘব করা হয়।
আইনের দৃষ্টিতে সকলে সমান : ছোট-বড়, ধনী-দরীদ্র, সাদা-কালো সকলের জন্য ইসলাম একই শাস্তি বিধান দেয়। দেশের কোনো ব্যক্তিই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
সংশোধনমূলক : আল্লাহর হক সম্পর্কিত অপরাধের জন্য ইসলাম অপরাধীকে তাওবা করার সুযোগ দেয়। খালিস নিয়্যতে তাওবা করলে মহান আল্লাহ তা ক্ষমা করে দেন। ফলে সে নিজে সংশোধিত হওয়ার সুযোগ পায়।
কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি : ইসলাম অপরাধের ক্ষেত্রভেদে বেত্রাঘাত, রজম ও শিরñেদের বিধান দেয়। এগুলো কঠোর ও কঠিন শাস্তি। এ শাস্তি জনসমক্ষে দিতে হবে, যেন সাধারণ মানুষ শাস্তির কঠোরতা দেখে অপরাধ করা থেকে বিরত থাকে। সামাজিক শাস্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য এরূপ শাস্তির প্রয়োজন অনস্বীকার্য।
ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য যা যা প্রয়োজন
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা যাতে রক্ষিত হয় এবং বিচার যেন বাদী ও বিবাদীর জন্য সহজলভ্য হয় এবং ন্যায়বিচারের সুফল যাতে জনগণ সহজে ভোগ করতে পারে এর জন্য নি¤েœাক্ত নীতিমালার প্রতি লক্ষ্য রাখা আবশ্যক :
বিচারকের নিকট পৌঁছতে কোন রকমের প্রতিবন্ধকতা না থাকা
ইসলাম দরিদ্র, অসহায় ও মাযলুম মানুষের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষে আদলতের দরজা উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এই ব্যবস্থায় কোনো কোর্ট ফি নেই। এই ব্যাপারে রাসূলুলাহ (সা.) বলেন- ‘আল্লাহ তাআলা তাঁর কোন বান্দাকে যদি মুসলমানদের কোনো বিষয়ে দায়িত্বভার অর্পণ করেন, এরপর সে ব্যক্তি যদি অভাবগ্রস্ত ও অসহায় লোকদের তার নিকট পৌঁছার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রাখে, তাহলে আল্লাহ তাআলাও তার প্রয়োজন পূরণ ও অভাব মোচনের ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি করে রাখবেন।'
৩.বাদী-বিবাদী উভয়ের সাথে একই ধরনের আচরণ করা
এ ব্যাপারে বিশ্বখ্যাত ‘ফাতওয়ায়ে শামী' গ্রন্থে উল্লেখ আছে-
ক. বিচারক মসজিদে বা বাড়িতে কিংবা এমন কোনো স্থানে বসে বিচার করবেন যেখানে প্রবেশ করার ব্যাপারে সকলের অনুমতি রয়েছে।
খ. তিনি বাদী-বিবাদী কারো নিকট থেকে হাদিয়া-উপহার গ্রহণ করবেন না। মুআয ইবনে জাবাল (রা.) বলেন, রসূলুল্লাহ (স.) আমাকে ইয়ামানে প্রেরণ কালে বললেন, আমার অনুমতি ব্যতীত কোন বস্তু গ্রহণ করবে না। কারণ তা প্রতারণার শামিল। যে ব্যক্তি প্রতারণা করবে কিয়ামতের দিন সে অবশ্যই প্রতারণার বস্তুসহ উপস্থিত হবে। এজন্য আমি তোমাকে ডেকেছি। এখন তোমার কাজে চলে যাও।
গ. বিচারক বাদী-বিবাদী কারো দাওয়াতে অংশগ্রহণ করবেন না।
ঘ. বাদী-বিবাদীদেরকে বসানো, তাদের প্রতি মনোযোগ প্রদান, ইশারা কিংবা সংকেতদান অথবা দৃষ্টিদানের ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের প্রতি সমতা বজায় রাখতে রসূলুল্লাহ (স.) নির্দেশ দিয়েছেন।
ঙ. কোন এক পক্ষের সাথে গোপন আলাপ, উচ্চৈঃস্বরে কথাবার্তা বলা, মুখোমুখি হাসা, তাদের সম্মানার্থে দাঁড়ানো এ জাতীয় কোন আচরণ না করতে রসূলুল্লাহ (স.) নির্দেশ দিয়েছেন।
চ. বিচার মঞ্চে বসে ঠাট্টা-মশকরা করবে না।
ছ. সাক্ষী কেমন করে সাক্ষ্য বাক্য উচ্চারণ করবে তা শিখাবে না।
জ. কোন পক্ষ এমন কথা বলবে না যা অপর পক্ষ বুঝতে অক্ষম।
৩. বাদী ও বিবাদীর দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন
ক. বাদী ব্যক্তি তার দাবির পক্ষে প্রমাণ পেশ করবে।
খ. বাদী প্রমাণ পেশ করতে না পারলে বিবাদী শপথ করবে। রসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন : ‘প্রমাণ পেশ করা বাদীর উপর কর্তব্য। আর অস্বীকারকারী (বিবাদী)-এর উপর শপথ করা বাধ্যতামূলক।
গ. শরীয়তবিরোধী না হওয়া পর্যন্ত বাদী-বিবাদী সর্বাবস্থায় সন্ধি করতে পারে।
ঘ. বিচারক তার বিবেচনা মতে ফয়সালা প্রদানের পর এ ব্যাপারে পুনঃবিবেচনা করার ইখতিয়ার রাখে।
ঙ. মামলা পেশ করার একটি নির্দিষ্ট দিন থাকা বাঞ্চনীয়।
চ. ভিনদেশী বা দূরদেশী লোকদের শুনানি আগে হওয়া বাঞ্চনীয়। অনুরূপভাবে মামলার এক পক্ষ দরিদ্র ও এক পক্ষ ধনী হলে আচরণের ক্ষেত্রে গরিবের প্রতি সহায়তার নযর প্রদান করা আবশ্যক।
ছ. মুসলমান মাত্রই সাক্ষ্যদানের উপযুক্ত। তবে যদি কোন ব্যক্তি সাজাপ্রাপ্ত হয় কিংবা কখনো মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছে বলে প্রমাণিত হয়, তবে এ জাতীয় ব্যক্তি আদালতে সাক্ষ্য দিতে পারবে না।
৪. বিচারকের জন্য ক্রোধান্বিত হওয়া বা খিটখিটে মেজাজের হওয়া অনুচিত (এ ব্যাপারে রসূল (স.) বলেন ঃ ‘ক্রোধাবস্থায় দু'পক্ষের মধ্যে বিচার করা বিচারকের জন্য শোভনীয় নয়।'
ক্ষুব্ধ অবস্থায় বিচারকার্য সম্পাদন করতে রসূলুল্লাহ (স.) নিষেধ করেছেন : যেমন তিনি বলেন : কোন বিচারক ক্রোধান্বিত অবস্থায় দুই ব্যক্তির মধ্যে ফয়সালা করবে না।
৫. মহিলা ও পুরুষের সাক্ষ্য ভিন্ন ভিন্ন স্থানে শ্রবণ করা বাঞ্চনীয়।
৬. কোনো বিষয় পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত রায় ঘোষণা না করা। (প্রয়োজনে সময় বৃদ্ধি করে নেয়া উত্তম। কোন মামলার ব্যাপারে রায় দিতে হাকিম অপারগ হলে তা উচ্চ আদালতে স্থানান্তরিত করা উচিত।
৭. বিচারের আসনে বসে উপদেষ্টাদের থেকে মতামত গ্রহণ না করা বাঞ্চনীয় (মতামত নেয়া আবশ্যক হলে তা ভিন্নভাবে নেয়া উচিত।)

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

কুরআন ও হাদীসের আলোকে হিংসা ও লোভ
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো ...
ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রেষ্ঠ সম্পদ
তাকফিরীরা জাহান্নামের কুকুর : ...
শবে বরাত
কথায় কথায় কাফির ঘোষণা, মুসলমানরা ...
ইসলামী বিচার পদ্ধতি
ইমাম হাসান (আ) এর বেদনা বিধুর ...
ইসলামের দৃষ্টিতে কর্ম ও শ্রম (৩য় ...
ইমামীয়া জাফরী মাজহাব-শেষ পর্ব

 
user comment