বাঙ্গালী
Saturday 20th of April 2024
1
نفر 0

ইবাদাতের সুষমায় অলঙ্কৃত আশুরা

ইবাদাত আসলে এমন এক আত্মিক ও মানসিক অবস্থা যার মাধ্যমে মানুষের সাথে আল্লাহর সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। ইবাদাতের মাধ্যমে আল্লাহর আনুগত্য প্রকাশ পায়। আর আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে মানুষের অক্ষমতার বিষয়টি যেমন ফুটে ওঠে তেমনি সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে একনিষ্ঠভাবে সাহায্য প্রার্থনার বিষয়টিও ফুটে ওঠে। ইবাদাতের মাধ্যমে মন ও আত্মা ছুটে যায় সেই মহান শক্তির দিকে যেই শক্তি মানব দেহে সঞ্চার করেছেন অলৌকিক প্রাণ। প্রার্থনা বা ইবাদাত মানুষের মাঝে সুপ্ত একটি স্বাভাবিক প্রবণতা। মানুষের মন এবং আত্মা তাই সবসময়ই মহান স্রষ্টার ইবাদাত করা তথা আল্লাহর সাথে সম্পর্ক ও যোগাযোগ সৃষ্টির মুখাপেক্ষি থাকে। ইবাদাত তাই হতে হবে সচেতনভাবে, ভালোবাসাপূর্ণ হৃদয়ে। যারা ইবাদাতের অবস্থায় থাকে তারা অহংকার এবং বড়ত্বের ভাব দেখানো থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে। সেইসাথে আল্লাহর দরবারে মোনাজাত দেওয়ার ক্ষেত্রে গভীরভাবে একনিষ্ঠ থাকে এবং আল্লাহর আনুগত্যের ছায়ায় প্রশান্তি খুঁজে পায়।

আরাফার দিনে আরাফাতের একটি প্রান্তে ইমাম হোসাইন (আ) তাঁর পরিবার পরিজনসহ সঙ্গী সাথীদের একটি দল নিয়ে তাঁবু থেকে বাইরে এলেন। জাবালুর রহমত নামক পাহাড়ের উপত্যকায় সমূহ বিনয় ও বিনম্রচিত্তে গেলেন এবং কাবার দিকে মুখ করে দুহাত উপরে তুলে মোনাজাত দিলেন। আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে শুরু করেছিলেন সেই মোনাজাত। আরাফাতে দেওয়া তাঁর সেই মোনাজাত এতোই শৈল্পিক ও হৃদয়গ্রাহী ছিল যে ইতিহাসে তা স্থান করে নিয়ে পরবর্তী প্রজন্মকে আজো আদর্শিক শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। এই দোয়াটি মানুষের অন্তরে তৌহিদ এবং আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার আলো জ্বালায়। ইমাম এই দোয়ার মধ্য দিয়ে চেয়েছেন আল্লাহকে চেনাতে এবং তাঁর কাছে মানুষের চাহিদার কথা তুলে ধরতে। ইমামের এই দোয়া মানুষের সাথে আল্লাহর সম্পর্কের যৌক্তিকতাকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।

দোয়াটির অংশবিশেষ তুলে ধরছিঃ...হে খোদা! যখনি তোমাকে ডেকেছি, তুমি সাড়া দিয়েছো! তোমার কাছে যখনই যা চেয়েছি আমাকে তা-ই তুমি দান করেছো!যখনই তোমার আনুগত্য করেছি তুমি প্রশংসা করেছো, ধন্যবাদ দিয়েছো। আর যখনই তোমার শুকরিয়া আদায় করেছি তুমি আমার ওপর তোমার নিয়ামত বা রহমত বর্ষণ বাড়িয়ে দিয়েছো।....হে দয়াময়, মেহেরবান! তোমার না কোনো সমকক্ষ আছে যে তার ইবাদাত করবো,না তোমার মতো কেউ আছে যাকে ডাকা যায়।কেবল তোমাকেই ডাকি এবং তুমিই আমার ডাকে সাড়া দিয়েছো এবং তোমার কাছেই যা কিছু প্রত্যাশা করি আর তুমিই আমার প্রত্যাশা মেটাও। তোমার দিকে ফিরি যাতে তুমি আমাকে তোমার রহমতে পরিপূর্ণ করে দাও!আর তোমার ওপর নির্ভর করি যাতে তুমি আমায় আশ্রয় দাও....!

শতাব্দির পর শতাব্দি হয়ে গেল আশুরার এই বিপর্যয়মূলক ঘটনাকে চিন্তাবিদগণ বিচিত্র দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করার চেষ্টা করেছেন। এই দুর্ঘটনা একদিকে চরম মানবিক অপরাধ এবং গভীর বিপর্যয়ের প্রকাশ। কেননা শত্রুরা ইমাম হোসাইন (আ) এবং তাঁর সঙ্গীদের ব্যাপারে চরম নিষ্ঠুরতা দেখিয়ে ইতিহাসের পাতায় একটি কালো অধ্যায় সংযোজন করেছে। অপরদিকে এই বিপ্লব সৌন্দর্য এবং মহত্বে ভরপুর। কারবালার মহান বিপ্লবে সম্মান, মর্যাদা, বীরত্ব ও সাহসিকতা আর প্রেম এবং আত্মত্যাগের সুষমা ঢেউ খেলে যায়। ইমাম হোসাইন (আ) এর বিপ্লবের সৌন্দর্যের মধ্যে রয়েছে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে তাঁরি পথে জীবন বিলিয়ে দেওয়ার জন্যে নির্বিঘ্নে এগিয়ে যাওয়া। এ জন্যেই এই বিপ্লবী যাত্রার সূচনা থেকেই আল্লাহর সাথে ইমামের গভীর যোগাযোগ ও সম্পর্কের কথা তাঁর বক্তব্যে ফুটে উঠেছে।

কুফার দিকে যাত্রাপথের বাঁকে বাঁকে ইমাম হোসাইন (আ) যেসব বক্তব্য রেখেছেন, সেসব বক্তব্যে তৎকালীন শাসক ইয়াযিদের অযোগ্যতার কথা স্পষ্টভাবে বলেছেন।এইসব বক্তব্য তিনি শুরু করেছিলেন আল্লাহর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে।তাঁর সেসব বক্তব্যে সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে তিনি প্রথমেই এক আল্লাহর শক্তি ও ক্ষমতা এবং তাঁর মর্যাদা সম্পর্কে সবাইকে অবহিত করেছেন। সেইসাথে ক্ষমতাসীন শক্তির ভয়ে ভীত অসচেতন জনতাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য কী আর শক্তির মূল উৎস কোথায়।

আল্লাহর ইবাদাতের দিক থেকে নিঃসন্দেহে আশুরার রাতটি ছিল ইমাম হোসাইন (আ) এবং তাঁর সঙ্গীসাথীদের জন্যে একান্তই আধ্যাত্মিকতাপূর্ণ সবচেয়ে সুন্দর ও মহৎ একটি রাত।ঐ রাতে কারবালা ছিল দোয়া আর ইবাদাতের গুঞ্জনে মুখরিত।সেদিন বিকেলে শত্রু পক্ষের সেনাপতি ওমর ইবনে সাদ যখন হামলা চালাবার আদেশ দিলো ইমাম তাঁর প্রিয় ভাই আব্বাসকে পাঠিয়ে বললেনঃ "যদি পারো তাদেরকে আগামিকাল পর্যন্ত যুদ্ধ পেছানোর ব্যাপারে রাজি করাতে চেষ্টা করো, যাতে নামায, দোয়া আর আল্লাহর ইবাদাত বন্দেগির মধ্য দিয়ে রাতটি কাটানোর সুযোগ মেলে।আল্লাহ রাব্বুল আলামিন জানেন, আমি তাঁর জন্যেই নামায এবং কোরআন তিলাওয়াত করতে ভালোবাসি।" নিঃসন্দেহে নামায হচ্ছে স্রষ্টার সাথে সম্পর্কের সবোর্ত্তম প্রকাশ। আধ্যাত্মিক এই সম্পর্ক এমনকি যুদ্ধের ময়দানেও মুজাহিদদের অন্তরে শক্তি ও সাহসের সঞ্চার করে।

আশুরার দিনে যুদ্ধের মাঝেই আবু সুমামা সায়েদি এসে ইমামকে বললেনঃ "হে আবা আব্দুল্লাহ! তোমার জন্যে আমার জীবন উৎসর্গিত। শত্রুসেনারা তোমার কাছাকাছি এসে গেছে,খোদার কসম আমি তোমার আগে মরতে চাই। কিন্তু ইচ্ছে করছে আল্লাহর দিদারে যাবার আগে তোমার সাথে নামাযটুকু পড়তে, এখন তো নামাযের সময় হয়েছে।" ইমাম হোসাইন (আ) আকাশের দিকে মাথা তুলে বললেনঃ "নামাযের কথা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিলে, আল্লাহ তোমাকে নামায আদায়কারী এবং যিকিরকারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন। হ্যাঁ! এখন নামাযের সময়।" এরপর বললেনঃ শত্রুদেরকে বলো আমাদেরকে যেন নামায পড়ার সুযোগ দেয়।"এক কুফি সেনা হাসিন বিন তামিম বললো "তোমাদের নামায কবুল নয়।" এর জবাব দিয়েছেন হাবিব বিন মাজাহির। তিনি হাসিনের সাথে তুমুল যুদ্ধ করে শহীদ হন।

জুহাইর বিন কিন এবং সায়িদ বিন আব্দুল্লাহ ইমামকে ঘিরে দাঁড়ালেন আর ইমাম তাঁর অবশিষ্ট সাথীদের অর্ধেককে নিয়ে যুদ্ধের বিশেষ নামায "নামাযে খাওফ" আদায় করলেন।নামায আদায়কালে শত্রুরা এতো বেশি তীর ছুঁড়ছিল যে একেবারে শেষ দিকে সায়িদ বিন আব্দুল্লাহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে শহীদ হয়ে যান।শাহাদাতের শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও ইমাম হোসাইন (আ) এবং সঙ্গীরা প্রমাণ করে গেছেন হোসাইনী বিপ্লবের মূলে ছিল খোদাওয়ান্দে সুবহানের প্রতি ভালোবাসা ও একনিষ্ঠ প্রেম। এই প্রেম হোসাইন (আ) এবং তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে যাক তাদের প্রেমিক মহান স্রষ্টা আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্যে-এই কামনায় শেষ করছি আজকের আলোচনা।


source : http://bangla.irib.ir/
1
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

রমজানের ফজিলত ও গুরুত্ব
অবিকৃত গ্রন্থ আল-কোরআন
ইমাম রেজা (আ.)'র কয়েকটি অলৌকিক ঘটনা
কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনা : একটি ...
Protest einer Antikriegsgruppe gegen Luftangriff Amerikas auf ein Krankenhaus
খলিফা নির্বাচনের পদ্ধতি
‘বাতিলের মুকাবিলায় ঐক্যই ...
অর্থসহ মাহে রমজানের ৩০ রোজার দোয়া
কোরআন ও চিকিৎসা বিজ্ঞান
শিয়াদের মৌলিক বিশ্বাস (পর্ব-১)

 
user comment

good
پاسخ
0     0
2012-11-25 05:13:30